Doctor safety India protests: পশ্চিমবঙ্গের আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ভারতজুড়ে ডাক্তারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গত ৯ আগস্ট এই ঘটনার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ডাক্তাররা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করেছেন। এই আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং দীর্ঘদিনের জমা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিমবঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ৪০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো সমাধান হয়নি। রাজ্য সরকার ডাক্তারদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও আন্দোলনকারীরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা বলছেন, তাঁদের পাঁচটি দাবির মধ্যে মাত্র কয়েকটি পূরণ করা হয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন।ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের নেতৃত্বে চলা এই আন্দোলনে হাজার হাজার চিকিৎসক অংশ নিয়েছেন।
তাঁরা দাবি করেছেন:
আন্দোলনকারী ডাক্তাররা বলছেন, “আমরা কাজ বন্ধ করে আনন্দ পাই না। কিন্তু অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। সরকারের দায়িত্ব এই সমস্যার সমাধান করা।”Indian Medical Association (IMA) এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে ভারতে প্রায় ৭৫% ডাক্তার কোনো না কোনো সময় রোগীর আত্মীয় বা অন্যদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক আক্রমণ, মৌখিক হুমকি এবং সম্পত্তি ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনকারী ডাক্তারদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছি। হাসপাতালগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।”
কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলছেন, শুধু অর্থ বরাদ্দ করলেই হবে না। তাঁরা চান স্বাস্থ্য সচিবকে অপসারণ করা হোক এবং হাসপাতালে বিদ্যমান হুমকি সংস্কৃতি দূর করা হোক। একজন জুনিয়র ডাক্তার জানিয়েছেন, “আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে ফিরতে চাই। কিন্তু সরকার আমাদের সব দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে এবং ডাক্তারদের কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে। কোর্ট বলেছে, “ডাক্তাররা যদি কাজে ফেরেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।” কিন্তু আন্দোলনকারীরা এখনো কাজে ফেরেননি।এই আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ।
সিনিয়র ডাক্তাররা অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন, কিন্তু তাতেও রোগীদের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। জরুরি বিভাগগুলো চালু থাকলেও বহির্বিভাগ ও পরিকল্পিত অপারেশনগুলো বন্ধ রয়েছে।একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, “এই আন্দোলন দেখিয়ে দিচ্ছে যে ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গভীর সংকট রয়েছে। শুধু নিরাপত্তা নয়, কর্মঘণ্টা, বেতন, পরিকাঠামো – সব ক্ষেত্রেই সমস্যা রয়েছে। সরকারকে এগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে।”ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১,৫০০ জনের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত অনুপাতের (১:১,০০০) চেয়ে অনেক কম। এছাড়া প্রতি ১,০০০ জনের জন্য মাত্র ১.৭ জন নার্স রয়েছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি ডাক্তারদের আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সরকার ডাক্তারদের বেশিরভাগ দাবি মেনে নিয়েছে। এখন তাদের উচিত সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আন্দোলন তুলে নেওয়া এবং সরকারের সাথে কাজ করা।”কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাঁরা মুখ্যসচিবের সঙ্গে আরও একটি বৈঠক চান। তাঁরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন, “আমরা আরও আলোচনা চাই। বিশেষ করে টাস্ক ফোর্স গঠন ও তার কার্যপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।”এই আন্দোলন শুধু পশ্চিমবঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। দিল্লি, মুম্বাই, হায়দরাবাদসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ডাক্তাররা সমর্থন জানিয়েছেন। ওড়িশা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশেও ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করেছেন।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আন্দোলন ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে।
রক্তাক্ত ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের বাঁচান মাননীয়া, সরকারের কঠোর অবস্থান
ডাক্তারদের নিরাপত্তা, কর্মঘণ্টা, বেতন, পরিকাঠামোগত সমস্যা – সবকিছুই এখন আলোচনায় এসেছে।একজন স্বাস্থ্য নীতি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “এই আন্দোলন থেকে সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত। শুধু তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক উন্নত করা, হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ – সব দিক নিয়েই ভাবতে হবে।”তিনি আরও বলেন, “ভারতের স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমানে জিডিপির মাত্র ১.৬% ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্যখাতে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত ৫% এর তুলনায় অনেক কম।”এদিকে, রোগীরা এই আন্দোলনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কলকাতার একজন রোগী জানিয়েছেন, “আমি অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু আন্দোলনের কারণে তা পিছিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই ডাক্তার ও সরকার দ্রুত একটা সমাধান বের করুক।” সুপ্রিম কোর্টও এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কোর্ট বলেছে, “ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু একই সঙ্গে ডাক্তারদেরও মনে রাখতে হবে যে তাঁদের পেশা মানবসেবার সঙ্গে জড়িত।”এদিকে, ভারতীয় চিকিৎসক সমিতি (IMA) এর সভাপতি ডা. সন্তনু সেন বলেছেন, “আমরা চাই সরকার ডাক্তারদের সুরক্ষার জন্য একটি কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন করুক। এছাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ডাক্তারদের উপর হামলা শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর আক্রমণ। এর ফলে ডাক্তাররা ভীত হয়ে পড়ছেন এবং অনেকে এই পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।”ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। আমরা ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছি। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা, মেটাল ডিটেক্টর ইত্যাদি লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক উন্নত করতে চাই। এজন্য রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ডাক্তারদের যোগাযোগ দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি সরকারের জন্য একটি সুযোগ যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার শুরু করতে পারে।স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডা. রবি দত্ত বলেছেন, “ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বড় হাসপাতালগুলোতে চাপ কম পড়ে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”তিনি আরও বলেন, “ডাক্তারদের কর্মঘণ্টা কমানো, বেতন বৃদ্ধি, পরিকাঠামো উন্নয়ন – এসব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষার মানও উন্নত করতে হবে।”এদিকে, রোগীদের মধ্যেও এই আন্দোলন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
অনেকে ডাক্তারদের দাবির সঙ্গে একমত হলেও আন্দোলনের কারণে সেবা না পাওয়ায় হতাশ।কলকাতার বাসিন্দা সুদীপ্ত চক্রবর্তী বলেন, “আমি ডাক্তারদের দাবির সঙ্গে একমত। তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু একই সঙ্গে রোগীদের কথাও ভাবতে হবে। অনেকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।”তিনি আরও বলেন, “সরকার ও ডাক্তারদের দ্রুত একটা সমঝোতায় আসা উচিত। এভাবে দীর্ঘদিন চললে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”এই আন্দোলন ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক সংকটকে তুলে ধরেছে। শুধু ডাক্তারদের নিরাপত্তা নয়, স্বাস্থ্যখাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, জনবলের অভাব – সব কিছুই এখন আলোচনায় এসেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংকট থেকে বের হতে হলে সরকারকে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদে ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হাসপাতালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।পাশাপাশি ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক উন্নত করতে উভয় পক্ষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের মধ্যে ধৈর্য ও সহানুভূতি বৃদ্ধি করতে হবে।
অন্যদিকে ডাক্তারদের যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করতে হবে।শেষ পর্যন্ত, এই আন্দোলন ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি মোড়ক পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিয়েছে। সরকার, ডাক্তার ও রোগী – সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সংকট থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা।ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যদি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পুনর্গঠিত করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যা শুধু ডাক্তার বা রোগী নয়, সমগ্র দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।