ড্যানিয়েল লেনিনের সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা সবাই জানি – “এমন দশক আছে যেখানে কিছুই ঘটে না, আবার এমন সপ্তাহ আছে যেখানে দশকের ঘটনা ঘটে যায়।” ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম একশত দিন দেখে মনে হচ্ছে, যেন বিশ্ব রাজনীতিতে কমপক্ষে ২০ বছরের পরিবর্তন ঘটে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে যে নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি সেই ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিদেশি সাহায্য কমানো, মিত্রদের সমালোচনা থেকে রাশিয়ার পক্ষ নেওয়া – নিজের অভূতপূর্ব কর্তৃত্ব দিয়ে ট্রাম্প বিশ্বকে নতুন করে সাজাতে চাইছেন।
আমেরিকা ফার্স্ট নীতির ইতিহাস ও বর্তমান রূপ
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কোনো নতুন ধারণা নয়। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীতে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে (১৯১৮-১৯৩৯) একটি অহস্তক্ষেপবাদী নীতির প্রতিফলন হিসেবে এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়েছিল। একশো বছর পর, ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম নির্বাচনী প্রচারে এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে (২০১৭-২০২১, ২০২৫-বর্তমান) এই স্লোগান ব্যবহার করেন।
আজকের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে:
-
অহস্তক্ষেপবাদ: আন্তর্জাতিক বিষয়ে কম জড়িত থাকা
-
আমেরিকান জাতীয়তাবাদ: দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া
-
রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি: আমদানির উপর শুল্ক আরোপ করে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা
ট্রাম্পের এই নীতি একটি মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি: “আমেরিকাকে প্রথমে রাখা” – যা সাধারণত বৈশ্বিক বিষয়াদি উপেক্ষা করে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতির উপর মনোনিবেশ করাকে বোঝায়।
প্রথম ১০০ দিনে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ ও পদক্ষেপ
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনে ১২৩টি নির্বাহী আদেশ, ৩৩টি স্মারকলিপি এবং ৩৩টি ঘোষণা জারি করেছেন। এটি হ্যারি এস. ট্রুম্যানের পর থেকে যে কোনো রাষ্ট্রপতির প্রথম বছরে সবচেয়ে বেশি নির্বাহী আদেশের সংখ্যা। তার দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাহী আদেশগুলির বিষয় অনুসারে, ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে সর্বাধিক (৩৩টি) নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপ্তি ও পরিমাণ এমন যে এর সহজ ঐতিহাসিক তুলনা করা কঠিন। তিনি নিউ ডিল এবং গ্রেট সোসাইটি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন, এবং এই ক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের ঐতিহ্যগত মুক্ত বাণিজ্য ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের আদর্শকেও চ্যালেঞ্জ করছেন।
“আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এমন একটি সমন্বিত, কৌশলগত পদ্ধতির প্রয়োজন যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করে।” – আমেরিকা ফার্স্ট ট্রেড পলিসি রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক যুদ্ধ
ট্রাম্প এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছেন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ককে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির অধীনে, তিনি শুল্ক ও রক্ষণাত্মক ব্যবস্থার আক্রমণাত্মক ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরায় আকার দিয়েছেন।
চীনের উপর ২৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করেছেন, যা একটি বাণিজ্য যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এর ফলে চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে, সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হয়েছে, এবং ব্যবসা ও ভোক্তাদের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কানাডা এবং মেক্সিকোর সাথে NAFTA পুনর্বিবেচনা করে USMCA (United States–Mexico–Canada Agreement) চালু করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপরও ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং কৃষি পণ্যের মতো পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছেন। এছাড়া, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (TPP) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক কমে গেছে, যা চীনকে অঞ্চলে তার অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করেছে।
অভিবাসন নীতি ও সরকার কাঠামো সংস্কার
ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুত গণবহিষ্কার কর্মসূচি শুরু করেছেন, এবং অভিবাসীদের খুঁজে বের করতে, আটক করতে এবং বহিষ্কার করতে আইআরএস থেকে পোস্টাল সার্ভিস পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সম্পৃক্ত করেছেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, তিনি কিছু অভিবাসীকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বিদেশী দেশে পাঠিয়েছেন, ১৮ শতকের একটি যুদ্ধকালীন বিধান উদ্ধৃত করে।
তিনি সরকারি কর্মচারীদের ভারী ছাঁটাই করেছেন, একশ হাজারেরও বেশি ফেডারেল কর্মী বরখাস্ত করেছেন। এই লক্ষ্যে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ককে ফেডারেল কর্মীবাহিনী কমাতে সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত করেছেন।
বৈদেশিক নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। তিনি NATO সহযোগীদের সমালোচনা করেছেন এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
টাইম ম্যাগাজিনের একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ইউক্রেনকে যুদ্ধ শুরু করার জন্য দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণ ছিল যখন তারা NATO-তে যোগদান নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিল।” তিনি এমন একটি সমঝোতা চুক্তি করার কথা বলেছেন যাতে ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনের ২০% এরও বেশি অঞ্চল দেওয়া হবে। “ক্রিমিয়া রাশিয়ার সাথেই থাকবে,” ট্রাম্প বলেছেন।
এছাড়াও তিনি সামরিক টহল ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের হুমকি দিয়ে গ্রীনল্যান্ড দখল করার কথা বলেছেন, যা NATO সহযোগী ডেনমার্কের অংশ। তিনি পানামা খাল ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছেন, এমনকি এর ফলে গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে সামরিক সংঘর্ষ হলেও। এসব বক্তব্য বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জনমত ও প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিনের কার্যক্রম নিয়ে আমেরিকা এবং বিশ্বজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-NORC সার্ভে অনুযায়ী, ৪৪% আমেরিকান মনে করেন ট্রাম্প ভুল বিষয়ে মনোনিবেশ করেছেন, অন্যদিকে মাত্র ২৪% মনে করেন তিনি সঠিক বিষয়ে নজর দিয়েছেন।
প্রায় অর্ধেক আমেরিকান (৪০%) ট্রাম্পকে “ভয়ানক” রাষ্ট্রপতি হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন, অন্যদিকে ১০% তাকে “খারাপ” বলেছেন। তবে, ৩০% আমেরিকান তাকে “দুর্দান্ত” বা “ভালো” রাষ্ট্রপতি হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন, আর ২০% তাকে “মাঝারি” বলেছেন।
এই জরিপে আরও দেখা গেছে যে আশা করা যায় এমনভাবেই, ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় মেয়াদে তার ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের আগের তুলনায় বেশি অসন্তুষ্ট। প্রায় ৭৫% ডেমোক্র্যাট মনে করেন ট্রাম্প ভুল বিষয়ে মনোনিবেশ করছেন, এবং ৭০% মনে করেন তিনি একজন “ভয়ানক” রাষ্ট্রপতি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, রিপাবলিকানরাও ট্রাম্পের কাজকর্মে পুরোপুরি খুশি নয়। জরিপে অংশ নেওয়া মাত্র ৫৪% রিপাবলিকান মনে করেন তিনি “সঠিক অগ্রাধিকার” নিয়ে কাজ করছেন।
বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য কী অর্থ বহন করে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে, তার নীতিগুলি ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা এলিয়ট আব্রামস, যিনি রোনাল্ড রিগ্যান এবং জর্জ ডব্লিউ. বুশের অধীনে কাজ করেছেন এবং পরে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইরান এবং ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি মন্তব্য করেছেন: “ট্রাম্প আট বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি চরমপন্থী এখন। আমি বিস্মিত হয়েছি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা মিত্রদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং শত্রুদের সাহসী করে তুলেছে, যা তার দ্বন্দ্বগুলি বাড়ানোর ইচ্ছা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। তার পদক্ষেপগুলির প্রভাব, এই অপ্রত্যাশিতার সাথে মিলিত হয়ে, কিছু সরকারকে এমন উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য করেছে যা অপরিবর্তনীয় হতে পারে, এমনকি ২০২৮ সালে একজন আরও পারম্পরিক যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় এলেও।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিন আমেরিকান ইতিহাসের অন্যতম অস্থিতিশীল সময় হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছে। ক্ষমতা দখল, কৌশলগত পরিবর্তন এবং সরাসরি আক্রমণের এই ধাক্কা বিরোধীদের, বৈশ্বিক অংশীদারদের, এবং এমনকি অনেক সমর্থককে হতবাক করে দিয়েছে।
তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বিশ্ব অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভবিষ্যতকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে। যেখানে তার সমর্থকরা এই পরিবর্তনকে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করেন, সেখানে সমালোচকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে।
বাকি থাকা আরও তিন বছর ট্রাম্প কীভাবে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন এবং বিশ্বের বাকি অংশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা আগামী দশকগুলিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করতে পারে।