কেরালার চিকিৎসা জগতে ইতিহাস রচিত হয়েছে ডাঃ ভিএস প্রিয়ার হাত ধরে। ত্রিশুরের এই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হয়ে উঠেছেন রাজ্যের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ডাক্তার। জন্মের সময় জিনু শশিধরণ নামে পরিচিত এই মানুষটি দীর্ঘ সংগ্রাম আর অদম্য সাহসিকতার মধ্য দিয়ে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে তিনি ত্রিশুরের সীতারাম আয়ুর্বেদ হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন এবং হাজারো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিত।
শৈশবকাল থেকেই ডাঃ প্রিয়া অনুভব করতে পেরেছিলেন যে তিনি একজন নারী। তবে পরিবার ও সমাজের কাছে এই সত্য প্রকাশ করতে তার বছরের পর বছর সময় লেগেছে। কলেজ জীবনে তিনি নিজের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখার জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। হাঁটাচলা থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক সবকিছুতেই পুরুষালি ভাব বজায় রাখতে হতো তাকে। এই মানসিক চাপ তার জীবনকে অত্যন্ত কষ্টকর করে তুলেছিল।
চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে ছিল পিতামাতার স্বপ্ন। দুজনেই নার্স হওয়ায় তারা চেয়েছিলেন সন্তানরা ডাক্তার হোক। প্রিয়ার ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতায় যাওয়ার, কিন্তু পিতামাতার খুশির জন্য তিনি মেডিকেলে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে ত্রিশুরের বৈদ্যরত্নম আয়ুর্বেদ কলেজে ভর্তি হয়ে ব্যাচেলর অফ আয়ুর্বেদা, মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিএএমএস) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিয়ে সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়ানোর জন্য মাঙ্গালোরে এমডি করেন।
বিশ্বে প্রথম! তেলেঙ্গানায় ট্রান্সজেন্ডার ট্র্যাফিক পুলিশ নিয়োগের সিদ্ধান্ত
শিক্ষাজীবন শেষে ডাঃ প্রিয়া সরকারি আয়ুর্বেদ মেডিকেল কলেজ ত্রিপুনিথুরা এবং কান্নুরে অতিথি প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু পেশাগত সাফল্যের পরও তার মনে ছিল এক গভীর অসন্তুষ্টি। নিজের প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রাখার যন্ত্রণা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। অবশেষে ২০১৮ সালে সীতারাম আয়ুর্বেদ হাসপাতালে যোগদানের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন না।
জেন্ডার রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করেন ডাঃ প্রিয়া। খরচ, পদ্ধতি এবং সার্জারির পরবর্তী প্রভাব নিয়ে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার চেষ্টা করেন। এরপর সাহস সংগ্রহ করে পিতামাতার কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেন। মা তার এই সিদ্ধান্তে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং বলেন, “সবাই বিরোধিতা করলেও আমি তোমার পাশে থাকব”।
পারিবারিক সমর্থন পেয়ে ডাঃ প্রিয়া ২০১৮ সালে কোচির রেনাই মেডিসিটিতে হরমোন থেরাপি শুরু করেন। ২০২০ সালে ডাঃ অর্জুন অশোকন এবং সুজা পি সুকুমার দম্পতির তত্ত্বাবধানে তিনি জেন্ডার রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করান। মোট ছয়টি সার্জারি সম্পন্ন করতে তার প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ হয়, যার ৯৫ শতাংশই বহন করেছেন তার পিতামাতা। লকডাউনের সময়টি তার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ প্রমাণিত হয়, কারণ সার্জারির পর পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলেন তিনি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের পরিচয় পরিবর্তনের বিষয়টি জানানোর সময় ডাঃ প্রিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কর্মকর্তা থেকে শুরু করে এমডি পর্যন্ত সবাই তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। যখন তিনি জানান যে এখন থেকে তাকে ডাঃ ভিএস প্রিয়া বলে ডাকতে হবে, তখন সবাই খুশি হয়ে সেই নামেই তাকে সম্বোধন করতে শুরু করেন।
রোগীদের প্রতিক্রিয়া নিয়েও চিন্তিত ছিলেন তিনি। নিয়মিত রোগীদের কাছে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নতুন পরিচয়ে ফিরে আসবেন। অধিকাংশ রোগীই কৌতূহলী ছিলেন সার্জারি সম্পর্কে জানতে। একজন ট্রান্সউইমেন ডাক্তার হিসেবে তিনি মনে করেন সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তিনি সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। জিনু একটি নিউট্রাল নাম হলেও তিনি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা কিছু। প্রথমে ‘জানকী’ নাম ভাবলেও পরে কাজিনের পরামর্শে ‘প্রিয়া’ নামটি বেছে নেন, যার অর্থ ‘সবার প্রিয়’। তার মতে নামটি যেন সহজ উচ্চারণযোগ্য এবং মধুর হয়, সেটাই তার লক্ষ্য ছিল।
কেরালার ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের ইতিহাসে ডাঃ প্রিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। তার আগে রাজ্যে ট্রান্সজেন্ডার আইনজীবী, পাইলট এবং অন্যান্য পেশার মানুষ থাকলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম। তবে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে ডাঃ বিভা উষা রাধাকৃষ্ণন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী প্রথম ট্রান্সউইমেন ডাক্তার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন কোঝিকোড় সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে।
বর্তমানে ডাঃ প্রিয়া শুধু একজন সফল চিকিৎসকই নন, বরং সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবেও কাজ করছেন। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণায় তার উপস্থিতি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। এরিয়েল ইন্ডিয়ার একটি বিজ্ঞাপনে তার গল্প তুলে ধরা হয়েছে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
তার সংগ্রামের গল্পে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে পারিবারিক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়, সেখানে ডাঃ প্রিয়া পেয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। তার মা প্রতিটি সার্জারির সময় পাশে থেকেছেন। অর্থনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি মানসিক সমর্থনও দিয়েছেন পরিবার, যা তার জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি।
কলকাতার সেরা ১০ নিউরোলজিস্ট: আপনার স্নায়ুরোগের সেরা চিকিৎসা নিশ্চিত করুন
চিকিৎসা পেশায় ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের উপস্থিতি সমাজে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছায়। ডাঃ প্রিয়ার মতে, তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন যে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরাও সমাজের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় অবদান রাখতে পারেন। ঐতিহ্যগতভাবে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট কিছু পেশায় সীমাবদ্ধ করে রাখার প্রবণতা রয়েছে, কিন্তু তার অর্জন সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে।
বর্তমানে ডাঃ প্রিয়া তার বাকি দুটি সার্জারি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছেন – ভয়েস থেরাপি এবং কসমেটিক সার্জারি। তিনি মনে করেন যে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রতিষ্ঠার এই যাত্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে তিনি চান যে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অন্য সদস্যরাও তার পথ অনুসরণ করে নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুক।
সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ডাঃ প্রিয়া নিয়মিত ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কাজ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে শিক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে সমাজে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন সম্ভব। তার নিজের উদাহরণ অনেক পিতামাতার কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে সন্তানের পরিচয় মেনে নেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কেরালার চিকিৎসা ইতিহাসে ডাঃ প্রিয়ার অবদান কেবল ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি প্রমাণ করেছেন যে যোগ্যতা এবং দক্ষতাই একজন চিকিৎসকের মূল পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয় নয়। তার রোগীরা তাকে বিশ্বস্ত চিকিৎসক হিসেবেই দেখেন, যা সমাজে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ডাঃ ভিএস প্রিয়ার যাত্রা কেবল একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি সামাজিক পরিবর্তনের একটি অনুপ্রেরণামূলক দলিল। তার সাহসিকতা, পারিবারিক সমর্থন এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক অনন্য উদাহরণ যা ভবিষ্যৎ পুরুষ্যরের জন্য পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবে।