ফ্যান্টাসি গেমিং-এর জগতে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার পর এ বার ভারতীয়দের আর্থিক বিনিয়োগের দুনিয়ায় নিয়ে আসতে চলেছে দেশের অন্যতম সফল ইউনিকর্ন Dream11। তাদের মূল সংস্থা ‘ড্রিম স্পোর্টস’-এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে এক নতুন প্ল্যাটফর্মের, যার নাম ‘ড্রিম মানি’ (Dream Money)। এই অ্যাপের মাধ্যমে সংস্থাটি তাদের কোটি কোটি গেমিং ব্যবহারকারীকে মিউচুয়াল ফান্ড এবং সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (SIP)-এর মতো আর্থিক উপকরণে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবে। খেলার রোমাঞ্চ এবং কৌশলকে কাজে লাগিয়ে যারা এতদিন দল সাজিয়েছেন, এ বার তারাই নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারবেন বিনিয়োগের মাধ্যমে। এই পদক্ষেপ অনলাইন গেমিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ফিনটেক জগতের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটাতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড্রিম স্পোর্টস-এর এই নতুন উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য হল তাদের বিশাল ব্যবহারকারী গোষ্ঠীকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ‘ড্রিম মানি’ অ্যাপটিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে, যাতে একজন সাধারণ মানুষ, যার শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান নেই, তিনিও খুব সহজে বিনিয়োগ শুরু করতে পারেন। প্রাথমিকভাবে এই অ্যাপে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের উপর জোর দেওয়া হবে। ব্যবহারকারীরা মাত্র ১০০ টাকা থেকেও সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি (SIP) শুরু করতে পারবেন। সংস্থার লক্ষ্য, খেলার মাঠে দল বানিয়ে জেতার যে আনন্দ, সেই একই রকম অনুভূতি বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রেও দেওয়া। ফ্যান্টাসি গেমিং অ্যাপের সরল ইন্টারফেস এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব ডিজাইনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ‘ড্রিম মানি’ তৈরি করা হচ্ছে।
বস্তুত, ফ্যান্টাসি গেমিং-এর দুনিয়ায় Dream11-এর পথচলা ছিল অভাবনীয়। হর্ষ জৈন এবং ভাবিত শেঠের হাত ধরে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এই সংস্থাটি আজ ভারতের ক্রীড়া প্রযুক্তির জগতে সবচেয়ে বড় নাম। বর্তমানে তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি, যাদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্ম। এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী, যারা ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন লেনদেনে স্বচ্ছন্দ, তারাই ‘ড্রিম মানি’-এর মূল লক্ষ্য। সংস্থাটি বুঝতে পেরেছে যে, এই ব্যবহারকারীদের যদি একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং সহজ প্ল্যাটফর্ম দেওয়া যায়, তবে তারা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য টাকা খরচ না করে, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগেও আগ্রহী হবেন। অনলাইন গেমিং-এর উপর সম্প্রতি ২৮% জিএসটি (GST) আরোপ হওয়ার পর সংস্থার রাজস্বের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে ব্যবসার বৈচিত্র্য আনাটাও একটা বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বিনিয়োগের এই পথ কিন্তু একেবারেই নিষ্কণ্টক নয়। ভারতীয় ফিনটেক বাজারে ইতিমধ্যেই Zerodha, Groww, Upstox এবং Paytm Money-এর মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থা রয়েছে, যারা লক্ষ লক্ষ গ্রাহককে পরিষেবা দিচ্ছে। এই কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদের জায়গা তৈরি করা ‘ড্রিম মানি’-এর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। যদিও Dream11-এর সবচেয়ে বড় শক্তি হল তাদের তৈরি গ্রাহক গোষ্ঠী। যেখানে অন্য সংস্থাগুলিকে নতুন গ্রাহক আকর্ষণ করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিজ্ঞাপন এবং маркетинগে খরচ করতে হয়, সেখানে Dream11 তাদের বর্তমান ব্যবহারকারীদেরকেই সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে পেতে পারে। এই ব্যবহারকারীদের বিশ্বাস অর্জন এবং তাদের আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি করাই হবে ‘ড্রিম মানি’-এর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, Dream11-এর এই পদক্ষেপ ভারতের খুচরো বিনিয়োগের বাজারে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। দেশের একটা বড় অংশের তরুণ প্রজন্ম, যারা এতদিন বিনিয়োগকে একটি জটিল এবং ভীতিকর বিষয় বলে মনে করত, তারা হয়তো খেলার ছলে নিজেদের চেনা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রথম বিনিয়োগটি শুরু করতে পারে। এটি একদিকে যেমন দেশের মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়াতে সাহায্য করবে, তেমনই দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রক নিয়মাবলী, যেমন সেবি (SEBI)-র নির্দেশিকা, কঠোরভাবে মেনে চলবে। ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষিত রাখা এবং তাদের একটি স্বচ্ছ বিনিয়োগের পরিবেশ দেওয়াই হবে তাদের প্রধান কর্তব্য।
এই নতুন অ্যাপটি প্রথমে ড্রিম স্পোর্টস-এর কর্মীদের জন্য চালু করা হবে এবং তাদের মতামত ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার পর এটি সমস্ত ব্যবহারকারীর জন্য খুলে দেওয়া হবে। সংস্থার লক্ষ্য হল, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ‘ড্রিম মানি’ অ্যাপটিকে ভারতের অন্যতম সেরা বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা। ফ্যান্টাসি পয়েন্টের হিসাব কষতে থাকা তরুণ প্রজন্ম যখন তাদের জীবনের আর্থিক লক্ষ্য পূরণের জন্য এসআইপি-র হিসাব কষতে শুরু করবে, তখনই এই উদ্যোগ真正 অর্থে সফল হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ক্রিকেট বা ফুটবলের ভার্চুয়াল মাঠ থেকে দেশের আর্থিক বাজারে Dream11-এর এই উত্তরণ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। খেলার কৌশল এবং টাকা জমানোর বুদ্ধিমত্তাকে এক সুতোয় গেঁথে ‘ড্রিম মানি’ অ্যাপটি ভারতের কোটি কোটি তরুণকে আর্থিক স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। এখন এটাই দেখার বিষয় যে, ফ্যান্টাসি গেমিং-এর চ্যাম্পিয়নরা বিনিয়োগের ময়দানে কতটা সফল হতে পারে। তাদের এই নতুন সফর যদি সফল হয়, তবে তা ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।