দুর্গাপূজার নবমী তিথিতে দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে মা দুর্গাকে বিদায় জানালেন ভক্তরা। রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে দশমী তিথি শুরু হলেও, শনিবার নবমী তিথিতেই দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে[3]। এই বছর দুর্গাপূজার আয়োজন ছিল অত্যন্ত জমজমাট, কিন্তু বিদায়ের সময় এসে গেলে ভক্তদের মনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
দর্পণ বিসর্জন হল একটি প্রথা যেখানে দেবী দুর্গার প্রতিমার সামনে একটি দর্পণ ধরা হয় এবং তার প্রতিবিম্ব দেখানো হয়। এই প্রথার মাধ্যমে বিশ্বাস করা হয় যে মা দুর্গা তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখেন এবং পরের বছর ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। এই মুহূর্তটি অত্যন্ত আবেগময় হয়ে ওঠে, কারণ ভক্তরা জানেন যে এর পরেই মা দুর্গা তাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
শুভ বিজয়া দশমী 2024: WhatsApp-এ প্রিয়জনদের পাঠান এই মর্মস্পর্শী শুভেচ্ছাবার্তাগুলি
দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব, যা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, বিহার, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পালিত হয়। এই উৎসব শরৎকালে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং মা দুর্গার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
এই বছরের দুর্গাপূজায় বিভিন্ন মণ্ডপে অসাধারণ সাজসজ্জা করা হয়েছিল। প্রতিমার সৌন্দর্য, আলোকসজ্জা, এবং মণ্ডপের নকশা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভোগ বিতরণ, এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই উৎসব আরও জমজমাট হয়ে উঠেছিল।
দুর্গাপূজার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। পুরাণে বর্ণিত আছে যে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর নামক এক শক্তিশালী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কাহিনী অনুসারে, মহিষাসুর দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গের অধিকার নিয়েছিল। তখন সমস্ত দেবতারা মিলিত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের কাছে সাহায্য চাইলেন। তাদের ক্রোধ থেকে উৎপন্ন হল এক মহাশক্তি, যা পরে দশভুজা দেবী দুর্গার রূপ নিল।
দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বোধন, অধিবাস, ষষ্ঠী পূজা, সপ্তমী পূজা, অষ্টমী পূজা, নবমী পূজা, এবং দশমী পূজা। প্রতিদিন বিশেষ মন্ত্র পাঠ, আরতি, ভোগ নিবেদন, এবং প্রসাদ বিতরণ করা হয়। কুমারী পূজাও এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে কন্যা শিশুদের দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে পূজা করা হয়।
দর্পণ বিসর্জনের পর, দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সমাপ্তি ঘটে। এই সময় ভক্তরা শোভাযাত্রা করে প্রতিমা নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যান এবং সেখানে বিসর্জন করেন। এই মুহূর্তটি অত্যন্ত আবেগময় হয়, কারণ ভক্তরা জানেন যে মা দুর্গা আবার এক বছরের জন্য তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবেরও প্রতীক। এই সময় বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে উৎসব উদযাপন করেন। মণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, গান-বাজনা, এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও, অনেক স্থানে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের মাঝে খাবার ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়।
দুর্গাপূজা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক মিলন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, এবং আনন্দ উল্লাসের একটি সুযোগ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকেন।
যদিও দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে মা দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়েছে, কিন্তু ভক্তদের মনে আশা জাগে যে আগামী বছর আবার মা দুর্গা ফিরে আসবেন। তাই বিদায়ের বেদনার মধ্যেও তারা বলেন, “আসছে বছর আবার হবে”। এই আশা ও প্রত্যাশা নিয়েই ভক্তরা আগামী বছরের দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু করেন।
দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই উৎসব মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সহমর্মিতা, এবং একতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়। যদিও মা দুর্গা চলে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি রেখে যাচ্ছেন তার আশীর্বাদ এবং ভালোবাসা, যা ভক্তদের সারা বছর ধরে অনুপ্রাণিত করবে।