শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আর শিউলি ফুলের গন্ধ জানান দেয়, মা আসছেন। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার ঘণ্টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। প্রতি বছর উমার মর্ত্যে আগমন এবং কৈলাসে ফিরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বাঙালির আনন্দ-উদ্বেগের শেষ থাকে না। শাস্ত্রমতে, দেবীর এই আগমন ও গমন হয় বিশেষ বিশেষ যানে, যার ওপর নির্ভর করে গোটা বছরের भविष्य। এই বছর দেবী কিসে আসছেন, গজ না দোলায়—এই প্রশ্নই ঘুরছে সবার মনে। তবে পঞ্জিকা বলছে, এবছর দেবী গজ বা দোলায় নয়, আসছেন নৌকায়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক এর শাস্ত্রীয় তাৎপর্য ও ফলাফল।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী, দুর্গাপূজার সূচনা হয় মহালয়ার দিন থেকে। এই দিন দেবী কোন বাহনে চড়ে মর্ত্যে আসছেন, তা নির্ধারিত হয়। আবার বিজয়া দশমীর দিনের ওপর ভিত্তি করে ঠিক হয় তাঁর ফেরার বাহন। এই বছর মহালয়া পড়েছে বুধবার এবং বিজয়া দশমী পড়েছে শুক্রবার। সপ্তাহের এই দিনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই দেবীর আগমন ও গমনের বাহন নির্ধারিত হয়। পঞ্জিকা মতে, বুধবারে দেবীর আগমন হলে তাঁর বাহন হয় নৌকা। ঠিক তেমনই, শুক্রবারে দেবীর গমন হলেও তাঁর বাহন হয় নৌকা। অর্থাৎ, এবছর দেবী দুর্গার আগমন ও গমন—উভয়ই ঘটবে নৌকায়।
দেবীর নৌকায় আগমনকে শাস্ত্র অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে। নৌকার সঙ্গে জল ও শস্যের গভীর যোগ রয়েছে। তাই যখন দেবী নৌকায় চড়ে আসেন, তখন তার ফলস্বরূপ পৃথিবীতে শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বসুন্ধরা হয়ে ওঠে শস্যশ্যামলা। চারিদিকে ধনধান্যে ভরে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কৃষকদের মুখে হাসি ফোটে, দেশ সম্পদে পরিপূর্ণ হয়। এক কথায়, এটি অত্যন্ত শুভ একটি ইঙ্গিত। তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। জলবৃদ্ধির কারণে অনেক সময় বন্যার আশঙ্কাও থাকে। অর্থাৎ, একদিকে যেমন সুজলা-সুফলা বসুন্ধরার প্রতিশ্রুতি, তেমনই অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও বহন করে দেবীর নৌকায় আগমন।
অন্যদিকে, দেবীর নৌকায় গমনের ফলাফলও প্রায় একই। শাস্ত্র বলছে, দেবীর নৌকায় প্রত্যাবর্তনের অর্থ হলো পৃথিবীতে সুখ, সমৃদ্ধি ও শস্যের প্রাচুর্য রেখে যাওয়া। অর্থাৎ, যে উন্নতির ধারা তিনি আগমনের মাধ্যমে শুরু করেন, তা প্রস্থানের পরেও বজায় থাকে। এর ফলে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, তেমনই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। তবে এক্ষেত্রেও জলবৃদ্ধি বা বন্যার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই আগমন এবং গমন উভয়ই নৌকায় হওয়ায় এই বছর একদিকে যেমন বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা প্রবল, তেমনই বন্যা বা অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়েও সচেতন থাকা প্রয়োজন।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, গজ বা দোলায় আগমনের অর্থ কী? শাস্ত্রমতে, রবিবার বা সোমবার দেবীর আগমন বা গমন হলে তাঁর বাহন হয় গজ বা হাতি। গজে আগমন বা গমন অত্যন্ত শুভ ফলদায়ক। এর ফলে পৃথিবীতে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও শস্যপূর্ণা পরিবেশ বজায় থাকে। আবার বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার আগমন হলে দেবীর বাহন হয় দোলা বা পালকি। দোলায় আগমনকে খুব একটা শুভ বলে মনে করা হয় না। এর ফলে মড়ক, মহামারী বা বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা থাকে, যা বহু মানুষের প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
একইভাবে, শনি বা মঙ্গলবার দেবীর আগমন বা গমন হলে তাঁর বাহন হয় ঘোটক বা ঘোড়া। ঘোটকে আগমন বা গমনও অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। এর ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা ছত্রভঙ্গের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ, দেবীর প্রতিটি বাহনই প্রকৃতির এবং মানবসমাজের ভবিষ্যতের এক একটি প্রতীকী রূপ। এই বিশ্বাস বহু যুগ ধরে বাঙালি সমাজে প্রচলিত এবং আজও মানুষ পঞ্জিকার এই বিধানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করে।
এই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার একটি বাস্তবসম্মত দিকও রয়েছে। প্রাচীনকালে কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষের জীবনযাত্রা মূলত প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্ষা, খরা বা বন্যা—এসবই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত। সম্ভবত সেই সময়ের ঋষি ও পণ্ডিতেরা প্রকৃতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সপ্তাহের দিনের সঙ্গে ফলাফলের একটি প্রতীকী স্থাপন করেছিলেন। যেমন, নৌকার সঙ্গে জল ও শস্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই নৌকায় আগমনকে তাঁরা শস্যবৃদ্ধি ও জলবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যা একটি স্বাভাবিক কৃষিভিত্তিক পর্যবেক্ষণ।
পরিশেষে বলা যায়, এবছর দেবী দুর্গার নৌকায় আগমন ও গমন একদিকে যেমন সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বার্তা বহন করছে, তেমনই জলপ্লাবনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে সতর্কবার্তাও দিচ্ছে। এই বিশ্বাস ও সংস্কার বাঙালির দুর্গাপূজার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উৎসবের আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন থাকাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মায়ের আগমনে পৃথিবী শস্যপূর্ণা হোক এবং সকল প্রকার দুর্যোগ থেকে বিশ্ব রক্ষা পাক—এটাই সকলের প্রার্থনা। দেবী দুর্গার আগমন ও গমনের এই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।