ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গাপুজো এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব হিসাবে নয়, দুর্গাপুজো ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম যেখানে তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এই উৎসবটি জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার এবং স্বদেশী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই দুর্গাপুজো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। বিপিন চন্দ্র পাল তখন “স্বদেশী পুজা” উৎসবের আয়োজন করেন, যা দেশীয় পণ্যের প্রচার এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরোধিতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
প্রতিবাদের মুখে দুর্গাপুজো: RG Kar কাণ্ডের ছায়ায় বাংলার উৎসব
এর পর থেকেই দুর্গাপুজো ক্রমশ স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো আয়োজন করেন। তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে সাথে ভারতের সনাতন ধর্মের মূল সত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।১৯০৮ সালে অরবিন্দ ঘোষ দুর্গাপুজোকে ব্যবহার করেন ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সৈনিক তৈরি করতে। তিনি উৎসবের আধ্যাত্মিক শক্তিকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তিতে রূপান্তরিত করেন।সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯২৮ সাল থেকে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে এই পুজো জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
পুজো মণ্ডপে স্বদেশী পণ্যের প্রদর্শনী, দেশাত্মবোধক নাটক ও গান পরিবেশন করা হত। এমনকি দেবী দুর্গাকে খাদি পরিয়ে স্বদেশী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়।১৯২৯ সাল থেকে নেতাজীর অনুপ্রেরণায় সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হয় স্বদেশী মেলা। বিদেশী পণ্যের পরিবর্তে বিক্রি হতে থাকে স্বদেশী সামগ্রী। এই মেলা ছিল স্বদেশী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম।১৯৩৭ সালে বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কয়েকজন সদস্য মিলে কলকাতার হেদুয়ার কাছে কাশী বোস লেনে শুরু করেন একটি দুর্গাপুজো। এই পুজো মণ্ডপে পুলিশের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে বিপ্লবীরা এখানে নিরাপদে তাদের কার্যকলাপ চালাতে পারতেন। পুজোর সময় ১১ জন পুরোহিত থাকতেন, যার মধ্যে একজন আসল পুরোহিত থাকতেন আর বাকিরা ছিলেন বিপ্লবীরা। এভাবে ছদ্মবেশে মায়ের মণ্ডপেই গোপনে চলত বিপ্লবী কার্যকলাপ।বিবেকানন্দ রোডের সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত।
বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে শুরু হওয়া এই পুজোয় অষ্টমীর দিন “বীরাষ্টমী” পালন করা হত। দেবীর সামনেই চলত লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, তরোয়াল চালানোর প্রতিযোগিতা। এছাড়াও যাত্রাপালা, কবিয়াল গান, পুতুল নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশাত্মবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হত।শুধু সার্বজনীন পুজোই নয়, অনেক বনেদি বাড়িও স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। ডায়মন্ড হারবারের নন্দী বাড়ির সদস্যরা সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। সেই বছর থেকেই প্রতিবাদস্বরূপ দেবীর গায়ে বিদেশি কাপড়ের পরিবর্তে পরানো হয় স্বদেশী শাড়ি।কলকাতার অনেক বাড়িতেও পুজোয় বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে স্বদেশী সামগ্রী ব্যবহারের রীতি শুরু হয়।
দশমীতে বিসর্জনের পর অনেকে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরতেন।১৯২৫ সালে মান্দালয় জেলে থাকাকালীন সুভাষ চন্দ্র বসু দুর্গাপুজো আয়োজনের অনুমতি চান। প্রথমে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে চায়নি। কিন্তু বসু ও অন্যান্য বন্দীদের অনশনের ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের অনুমতি দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে দুর্গাপুজো কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একতাবদ্ধ করেছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।১৯৪২ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের সময় নেতাজী “আজাদ হিন্দ পুজা” আয়োজন করেন। তিনি বলেন, দেবী দুর্গা শুধু ভালোর উপর মন্দের জয়ের প্রতীক নয়, তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রতীক।দুর্গাপুজোর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী নেতারা সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুজো মণ্ডপগুলি হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মিলনকেন্দ্র।
এখানে তারা গোপনে বৈঠক করতেন, কৌশল নির্ধারণ করতেন এবং আন্দোলনের পরিকল্পনা করতেন।বিভিন্ন পুজো কমিটি স্বদেশী পণ্যের প্রদর্শনী আয়োজন করত। এর মাধ্যমে স্বদেশী শিল্পকে উৎসাহিত করা হত এবং বিদেশি পণ্য বর্জনের বার্তা দেওয়া হত। অনেক পুজো মণ্ডপে দেশাত্মবোধক গান, নাটক ও আবৃত্তির আসর বসত। এগুলির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগানো হত।দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনা সভার আয়োজন করা হত। এসব সভায় স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব ও ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা হত। এভাবে দুর্গাপুজো হয়ে উঠেছিল জনসচেতনতা সৃষ্টির একটি কার্যকর মাধ্যম।বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪০-এর দশকে কলকাতায় প্রায় ২০০টি বড় সার্বজনীন দুর্গাপুজো হত। এর মধ্যে অন্তত ৫০টি পুজো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এছাড়া হাজার হাজার ছোট পুজোও বিভিন্নভাবে আন্দোলনকে সমর্থন করত।