কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গলের ডুরান্ড কাপের ম্যাচে গ্যালারিতে ঝোলানো হয়েছে একটি বিশাল ব্যানার— “ভারত স্বাধীন করতে সে দিন পরেছিলাম ফাঁসি! মায়ের ভাষা বলছি বলে আজকে ‘বাংলাদেশী’?” এই প্রতিবাদী বার্তার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে খেলার মাঠ শুধু ক্রীড়ার জন্য নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবেও কাজ করে।
বিশ্বব্যাপী খেলার ইতিহাসে প্রতিবাদের এমন ঘটনা অসংখ্য। অলিম্পিক থেকে শুরু করে ফিফা বিশ্বকাপ পর্যন্ত, প্রতিটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাতেই কোনো না কোনো সময় দর্শক বা খেলোয়াড়রা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালের অলিম্পিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যখন ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণে পরস্পর বিরোধী দেশগুলো একে অপরের অলিম্পিক বর্জন করেছিল।
আমেরিকায় ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সৃষ্ট ‘ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার’ আন্দোলনে মাইকেল জর্ডন, সেরিনা উইলিয়ামস, লেব্রন জেমসের মতো বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদরা যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলোয়াড়রা ম্যাচ শুরুর আগে হাঁটু মুড়ে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে এমন প্রতিবাদের ধারা তুলনামূলক কম হলেও কলকাতার ফুটবল মাঠে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা নিয়মিতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে আসছেন। ২০২০ সালে এনআরসি-র সময় ডার্বির গ্যালারিতে ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’ ব্যানার উড়েছিল, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
গত বছর আরজি কর মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে চিকিৎসক নির্যাতনের ঘটনার পর কলকাতার ফুটবল গ্যালারিতে প্রতিবাদ নতুন মাত্রা পেয়েছিল। মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা একসাথে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। এমনকি ডুরান্ড কাপের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ বাতিল করা হয়েছিল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে। ওই দিন অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে যুবভারতীর কাছে জড়ো হয়েছিলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সমর্থকরা।
আরজি করের ঘটনার পর কলকাতা লিগের বিভিন্ন ম্যাচে গোলপোস্টের পিছনের গ্যালারিতে প্রতিবাদী ব্যানার-টিফো দেখা গিয়েছিল। সেখানে লেখা থাকত, ‘তিলোত্তমার রক্ত-চোখ, আঁধার রাতে মশাল হোক’। এই ধরনের স্লোগান ও বার্তা প্রমাণ করে যে ফুটবল গ্যালারি শুধু খেলা দেখার জায়গা নয়, বরং সামাজিক চেতনা প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার খবর আসার সময়ও লাল-হলুদ গ্যালারিতে ব্যানার দেখা গিয়েছে— ‘সংখ্যালঘুর রক্ত মুছে ফেললেই চলবে? দেশান্তরী স্মৃতিগুলো সব ঢাকতে তুমি কি পারবে?’ এই ধরনের বার্তা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেয়।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের এই প্রতিবাদী ভূমিকার পেছনে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক কারণ। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা মূলত ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। দেশভাগের সময় তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা এই বাংলায় এসে বসতি গড়ে নিরন্তর লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ফলে তাদের সাথে বাংলাদেশের রক্তের টান রয়েছে এবং বাংলা ভাষার প্রতি রয়েছে গভীর মমত্ববোধ।
‘আলট্রাজ’ নামে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের একটি সংগঠন মূলত এই ধরনের প্রতিবাদ সংগঠিত করে থাকে। তাদের অন্যতম সংগঠক কৃষ্ণেন্দু দত্ত জানিয়েছেন যে ভবিষ্যতেও তারা যেকোনো ‘সামাজিক বর্বরতা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবেন। তার ভাষায়, “আমরা যেকোনো ধরনের সামাজিক বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব হই। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের অবশ্যই ফেরৎ পাঠানো হোক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষায় কথা বললেই তিনি বাংলাদেশি!”
East Bengal ISL 2024-25: ইস্টবেঙ্গলের হতাশাজনক শুরু, গোয়ার বিপক্ষে হারের পর কোচের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
ইতিহাস বলে যে এ দেশে খেলার মাঠে প্রতিবাদী ভূমিকায় ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদেরই বেশি দেখা গিয়েছে। এর কারণ হিসেবে ক্লাবটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে উল্লেখ করা যায়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তৈরি হয়েছিল শুধু ফুটবল খেলার জন্য নয়, বরং এক সামাজিক পরিচয়ের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলার মাঠে প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে নানা কারণে। ১৯৭২ এবং ১৯৭৬ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অধিকাংশ আফ্রিকান রাষ্ট্র বর্জনের হুমকি দিয়েছিল, যাতে জাতিগত বিভাজনকারী দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়া অলিম্পিকে নিষিদ্ধ হয়। আইওসি দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও নিউজিল্যান্ডকে নিষিদ্ধ করতে রাজি হয়নি। ফলে কুড়িটি আফ্রিকান দেশ, গায়না ও ইরাকের সঙ্গে মিলে ১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক বর্জন করেছিল।
প্রাচীন অলিম্পিক গেমস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিশ্বকাপ পর্যন্ত, ক্রীড়াঙ্গন সবসময়ই রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা প্রেরণের একটি কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল, যখন ইতালীয় খেলোয়াড়রা জয়ের পর মাঠের ধারে মুসোলিনির সামনে ফ্যাসিস্ত সালাম দিতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়েও খেলার মাঠে প্রতিবাদের নানা ঘটনা ঘটেছে। খেলার মাঠ দখলের বিরুদ্ধে শিবচরে খেলোয়াড়দের মানববন্ধন, ভোলায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, এবং বিভিন্ন স্থানে ফুটবল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা প্রমাণ করে যে খেলাধুলা শুধু বিনোদন নয়, বরং সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আইএসএলে ব্যর্থতার জেরে বড় রদবদল, তিন বিদেশিকে ছাঁটাই করল ইস্টবেঙ্গল
ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির সাম্প্রতিক প্রতিবাদটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি ভাষাগত পরিচয় এবং জাতীয় পরিচয়ের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের দিকে আলোকপাত করেছে। বাংলা ভাষায় কথা বললেই কাউকে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করার প্রবণতার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, খেলার মাঠে প্রতিবাদের এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে ক্রীড়াঙ্গন কেবল খেলাধুলার জায়গা নয়, বরং মানুষের মনের কথা প্রকাশের একটি জীবন্ত মঞ্চ। অলিম্পিক থেকে বিশ্বকাপ, স্থানীয় লিগ থেকে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট— সর্বত্রই এই ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।