পূর্ব ভারতের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা আনতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এক যুগান্তকারী সামরিক সম্মেলনে যোগ দিতে চলেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সাথে এই ত্রিদিনব্যাপী কম্বাইন্ড কমান্ডার্স কনফারেন্সে দেশের সামরিক কৌশল ও পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা রোডম্যাপ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে।
“সংস্কারের বছর – ভবিষ্যতের জন্য রূপান্তর” মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পাবে প্রতিরক্ষা খাতে সংস্কার, রূপান্তর এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি। দেশের তিন বাহিনীর প্রধানসহ প্রতিরক্ষা সচিব ও অন্যান্য মন্ত্রকের সচিবরাও এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।
কলকাতায় এই সম্মেলন আয়োজনের পেছনে রয়েছে পূর্ব ভারতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষত বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটার এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যা নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
গত বছর লখনউয়ে অনুষ্ঠিত হলেও এবার কলকাতায় এই সম্মেলনের আয়োজন ইস্টার্ন কমান্ডের কৌশলগত গুরুত্বকে তুলে ধরে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
অপারেশন সিঁদুরের পর এই প্রথম শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের এত বড় সমাবেশ হতে চলেছে। গত মে মাসে পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে চালানো এই অভিযানের সাফল্য পূর্ব সীমান্তের সামরিক কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রথম দিন উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন, পরের দিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বক্তব্য রাখবেন। আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে থাকবে সামরিক আধুনিকীকরণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্স প্রযুক্তির ব্যবহার, হাইপারসনিক মিসাইল ও সাইবার নিরাপত্তা।
২০২৫ সালকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক “সংস্কারের বছর” ঘোষণা করেছে, যার অন্যতম লক্ষ্য ইউনিফাইড থিয়েটার কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা। এই ব্যবস্থায় তিন বাহিনী একসাথে কাজ করে বৃহত্তর ভৌগোলিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
পূর্ব ভারতের সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। মিয়ানমারের সরকারি বর্ডার গার্ড পুলিশ সীমান্তের পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এই এলাকায় নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০৪০ সালের যুদ্ধ রোডম্যাপ অনুযায়ী, পূর্ব সীমান্তে ১৮০০ ট্যাঙ্ক, ৫০০ হাইপারসনিক মিসাইল, লেজার ও ডিরেক্টেড এনার্জি অস্ত্র মোতায়েন করা হবে। স্থল, জল, আকাশ, সাইবার ও মহাকাশ – পাঁচ ক্ষেত্রেই প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
সীমান্ত নিরাপত্তায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। IR সেন্সর, উন্নত মানের ক্যামেরা, নাইট ভিশন ডিভাইস ও ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চালানো হচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশ সীমান্তে ফ্লাড লাইট ও সৌর বিদ্যুৎ চালিত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা কৌশলে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে মাল্টি-ডোমেইন অপারেশন। সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশে পরিচালিত ‘এক্সারসাইজ প্রচণ্ড প্রহার’ এর মাধ্যমে তিন বাহিনীর সমন্বিত যুদ্ধ কৌশল পরীক্ষা করা হয়েছে।
ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্বে রয়েছে ১৩৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চীন সীমান্ত, যার মধ্যে সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশ অন্তর্ভুক্ত। তিনটি কোর – ৩৩ কোর (সিকিম), ৪ কোর (কামেং সেক্টর) ও ৩ কোর (বাকি অরুণাচল প্রদেশ) দিয়ে এই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে এই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। ইসলামাবাদের সাথে ঢাকার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঝুঁকি বিবেচনা করে নতুন নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের প্রভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র পাচার, মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ও আসাম রাইফেলসের পাশাপাশি উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
এই সম্মেলনে সামরিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা শিল্পের আধুনিকীকরণও আলোচিত হবে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের আওতায় দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানিতে অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারত এখন অস্ত্র আমদানিকারক থেকে রপ্তানিকারক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
কলকাতায় এই সম্মেলনের আয়োজন পশ্চিমবঙ্গের কৌশলগত গুরুত্বকেও তুলে ধরে। বাংলাদেশ ও চীন সীমান্তের নৈকট্যে অবস্থিত এই রাজ্য জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই সম্মেলন রাজনৈতিক তাৎপর্যও বহন করে।
পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করবে এই সামরিক সম্মেলন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা ও মহাকাশ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সামরিক আধুনিকীকরণের পাশাপাশি তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি ও একীভূত কমান্ড স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে।