ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদক্ষেপের সাক্ষী থাকল। ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় পর দেশব্যাপী ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ বা Special Intensive Revision (SIR)-এর দ্বিতীয় পর্বের ঘোষণা করল। বিহারে প্রথম পর্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার পর, এই দ্বিতীয় পর্বে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং কেরালা সহ মোট ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নতুন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (CEC) জ্ঞানেশ কুমার এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি জানান, এই প্রক্রিয়ার অধীনে প্রায় ৫১ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই করা হবে। (সূত্র: পিটিআই, দ্য হিন্দুতে উদ্ধৃত, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
শেষবার এই ধরনের দেশব্যাপী নিবিড় সংশোধন হয়েছিল ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। তারপর থেকে প্রতি বছর নিয়মিত সংশোধন (Summary Revision) হলেও, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিটি ভোটারের তথ্য যাচাই করার এই ব্যাপক প্রক্রিয়া এই প্রথম।
কেন এই ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ (SIR)?
সাধারণ বার্ষিক সংশোধনের থেকে SIR সম্পূর্ণ আলাদা। বার্ষিক সংশোধনে মূলত নতুন ভোটারদের নাম তোলা বা ঠিকানা পরিবর্তনের আবেদন গ্রহণ করা হয়। কিন্তু SIR হল একটি ‘গ্রাউন্ড-আপ’ প্রক্রিয়া।
সিইসি জ্ঞানেশ কুমারের কথায়, “এসআইআর নিশ্চিত করবে যে কোনও যোগ্য ভোটার যেন বাদ না পড়েন এবং কোনও অযোগ্য ভোটার যেন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হন।” (সূত্র: লাইভ মিন্ট, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
কমিশনের মতে, গত ২১ বছরে ব্যাপক অভিবাসন (migration), মৃত্যু এবং ঠিকানা পরিবর্তনের কারণে ভোটার তালিকায় প্রচুর ‘অপ্রয়োজনীয়’ নাম জমা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি একাধিক জায়গায় ভোটার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন অথবা মৃত ব্যক্তির নাম তালিকা থেকে বাদ যায়নি। এই ‘ত্রুটিপূর্ণ’ তালিকা গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। তাই এই ‘শুদ্ধিকরণ’ প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কোন কোন রাজ্য এই পর্বে এবং সম্পূর্ণ সময়সূচি কী?
দ্বিতীয় পর্বের এই SIR প্রক্রিয়ায় যে ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং পুদুচেরিতে ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। এটি এই রাজ্যগুলির জন্য প্রক্রিয়াটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
তালিকাভুক্ত ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল:
- আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
- ছত্তিশগড়
- গোয়া
- গুজরাট
- কেরালা
- লাক্ষাদ্বীপ
- মধ্যপ্রদেশ
- পুদুচেরি
- রাজস্থান
- তামিলনাড়ু
- উত্তরপ্রদেশ
- পশ্চিমবঙ্গ
উল্লেখ্য, আসামে ২০২৬ সালে নির্বাচন থাকলেও, এই রাজ্যের জন্য SIR-এর তারিখ পরে আলাদাভাবে ঘোষণা করা হবে বলে কমিশন জানিয়েছে। (সূত্র: দ্য হিন্দু, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
পরিসংখ্যান ও প্রক্রিয়ার ধাপ
এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য কমিশন একটি বিস্তারিত সময়সূচি এবং পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
১. পরিসংখ্যান একনজরে:
- মোট ভোটার (এই পর্বে): প্রায় ৫১ কোটি
- বুথ লেভেল অফিসার (BLO): ৫.৩৩ লক্ষ (সূত্র: দ্য হিন্দু)
- রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্ট (BLA): ৭ লক্ষের বেশি (সূত্র: দ্য হিন্দু)
২. সম্পূর্ণ সময়সূচি (২০২৫-২০২৬):
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত সময়সূচি অনুযায়ী, প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত ধাপে সম্পন্ন হবে:
| প্রক্রিয়ার ধাপ | তারিখ |
| মুদ্রণ ও প্রশিক্ষণ (Printing & Training) | ২৮ অক্টোবর – ৩ নভেম্বর, ২০২৫ |
| বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণনা (House-to-house enumeration) | ৪ নভেম্বর – ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ |
| খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ | ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ |
| দাবি ও আপত্তি জানানোর সময়কাল | ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ – ৮ জানুয়ারি, ২০২৬ |
| দাবি ও আপত্তির নিষ্পত্তি | ৩১ জানুয়ারি, ২০২৬ পর্যন্ত |
| চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ | ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬ |
(সূত্র: দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)
ভোটারদের কী করতে হবে? নথিপত্র কি বাধ্যতামূলক?
কমিশন এই প্রক্রিয়াটিকে যতটা সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছে। সিইসি জ্ঞানেশ কুমার স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, বাড়ি বাড়ি গণনার (enumeration) পর্যায়ে ভোটারদের কোনও নথি জমা দিতে হবে না। (সূত্র: দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
প্রক্রিয়াটি হবে নিম্নরূপ:
১. ফর্ম বিতরণ: বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO) প্রতিটি বাড়িতে যাবেন এবং প্রতিটি বিদ্যমান ভোটারের জন্য একটি করে ‘ইউনিক এনুমারেশন ফর্ম’ (EF) দেবেন। এই ফর্মে ভোটারের বর্তমান বিবরণ থাকবে।
২. তথ্য যাচাই: ভোটারদের কাজ হল BLO-দের সাহায্য করা যাতে ২০০২-২০০৪ সালের শেষ SIR তালিকার সাথে তাদের নাম বা তাদের পরিবারের সদস্যদের নাম মেলানো (link) যায়।
৩. শনাক্তকরণ: এই প্রক্রিয়ায় BLO-রা মৃত, স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত এবং ডুপ্লিকেট ভোটারদের শনাক্ত করবেন।
যদিও গণনার সময় নথি বাধ্যতামূলক নয়, কমিশন যাচাইয়ের জন্য ১২টি ‘নির্দেশমূলক’ নথির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যা প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, জন্ম শংসাপত্র, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে জারি করা কোনও সরকারি পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত শংসাপত্র ইত্যাদি। সিইসি আরও একবার স্পষ্ট করেছেন যে আধার কার্ড পরিচয়ের প্রমাণ হতে পারে, কিন্তু নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। (সূত্র: লাইভ মিন্ট, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তাৎপর্য
২১ বছর পর এই ধরনের ব্যাপক ভোটার তালিকা সংশোধনের পদক্ষেপকে বিভিন্ন মহল থেকে স্বাগত জানানো হলেও, এর রাজনৈতিক তাৎপর্যও গভীর।
- স্বচ্ছ নির্বাচন: রাজনৈতিক দলগুলি দীর্ঘদিন ধরেই ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছিল। এই পদক্ষেপ সেই দাবিকেই মান্যতা দিল। একটি পরিষ্কার তালিকা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
- অভিবাসন ও নাগরিকত্ব: এই প্রক্রিয়াটি অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের (internal migration) একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে পারে। একই সাথে, কমিশন “কোনও অযোগ্য ভোটারের অন্তর্ভুক্তি” (wrongful inclusion) রোখার যে কথা বলেছে, তা নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সংবেদনশীল হতে পারে।
- ২০২৬-এর নির্বাচন: পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র, সেখানে ভোটার তালিকা থেকে কয়েক লক্ষ ‘ভুত’ বা ‘নকল’ নাম বাদ পড়লে তা নির্বাচনের সমীকরণকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই SIR প্রক্রিয়াটি কেবল একটি প্রশাসনিক কাজ নয়, এটি ভারতের নির্বাচনী পরিকাঠামোকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আগামী তিন মাস ধরে চলা এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণই এর সাফল্যকে নিশ্চিত করবে।











