স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর সেরা সময়: সকালে পড়া নাকি রাতে? জেনে নিন বিজ্ঞান কী বলছে

পড়াশোনা এবং স্মৃতিশক্তির মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি হলো সঠিক সময়ে পড়া এবং তা মনে রাখা। কিন্তু দিনের কোন সময়ে পড়লে স্মৃতিশক্তি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়,…

Laboni Das

 

পড়াশোনা এবং স্মৃতিশক্তির মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি হলো সঠিক সময়ে পড়া এবং তা মনে রাখা। কিন্তু দিনের কোন সময়ে পড়লে স্মৃতিশক্তি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ ভোরের ব্রাহ্মমুহূর্তকে পড়াশোনার জন্য আদর্শ মনে করেন, আবার কেউ রাতের নিস্তব্ধতাকে বেছে নেন। এই প্রবন্ধে আমরা এই দুই সময়ের সুবিধা-অসুবিধাগুলো তুলে ধরব এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর সেরা সময় কোনটি, তা জানার চেষ্টা করব।

সকালে পড়ার সুবিধা

১. মস্তিষ্ক থাকে সতেজ: সারারাত ঘুমের পর সকালে আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি সতেজ এবং কর্মক্ষম থাকে। এই সময়ে মস্তিষ্কের গ্রহণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ থাকে, ফলে নতুন কিছু পড়া বা বোঝা অনেক সহজ হয়।

২. প্রাকৃতিক আলোর প্রভাব: দিনের আলোতে পড়াশোনা করলে চোখের ওপর চাপ কম পড়ে এবং মনও সতেজ থাকে। ভোরের আলো আমাদের শরীরের ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ বা দেহঘড়িকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে, যা আমাদের মেজাজ ভালো রাখে এবং মনোযোগ বাড়ায়।

৩. মনোযোগের একাগ্রতা: সকালে পরিবেশ সাধারণত শান্ত থাকে। কোলাহল কম থাকায় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা যায়। এই সময়ে ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মতো distrctions-ও কম থাকে, যা পড়াশোনার জন্য খুবই জরুরি।

৪. পরিকল্পনা করার সুযোগ: সকালে পড়াশোনা শেষ করে ফেললে সারা দিন অন্যান্য কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

রাতে পড়ার সুবিধা

১. স্মৃতিশক্তি মজবুত হয়: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, রাতে পড়ার পর ঘুমালে সেই পড়া স্মৃতিতে ভালোভাবে গেঁথে যায়। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক দিনের বেলায় শেখা তথ্যগুলোকে সংগঠিত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে। একে ‘মেমরি কনসোলিডেশন’ (Memory Consolidation) বলা হয়।

২. সৃজনশীলতার বিকাশ: রাতের শান্ত ও নিস্তব্ধ পরিবেশে সৃজনশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে। এই সময়ে মস্তিষ্ক অনেক বেশি সৃষ্টিশীল থাকে, যা নতুন কোনো বিষয় বোঝা বা জটিল সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে।

৩. কম বাধা-বিপত্তি: রাতে বাইরের জগতের কোলাহল এবং মানুষের আনাগোনা কম থাকে। ফলে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ পাওয়া যায়।

৪. নমনীয়তা: যারা দিনের বেলায় স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাদের জন্য রাতে পড়াশোনা করা সুবিধাজনক।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী বলছে?

স্মৃতিশক্তি এবং ঘুমের সম্পর্ক নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। ‘Nature Neuroscience’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নতুন কিছু শেখার পর ঘুমিয়েছেন, তারা যারা জেগে ছিলেন তাদের তুলনায় সেই তথ্য ভালোভাবে মনে রাখতে পেরেছেন। ঘুমের সময়, বিশেষ করে ‘নন-র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট’ (NREM) পর্যায়ে, আমাদের মস্তিষ্ক নতুন শেখা তথ্যগুলোকে সংগঠিত করে এবং স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে।

অন্যদিকে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ ম্যাথিউ ওয়াকারের মতে, শেখার আগে ঘুম মস্তিষ্কের নতুন স্মৃতি গঠনের জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। এবং শেখার পরে ঘুম সেই নতুন তথ্যকে মস্তিষ্কের স্থাপত্যে সংরক্ষণ এবং সিমেন্ট করতে অপরিহার্য। এর মানে হল যে আপনার এটি ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, недосыпа বা ঘুমের অভাব শেখার ক্ষমতা ৪০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। তাই পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াশোনা করা একেবারেই উচিত নয়।

গাণিতিক তথ্য ও বিশ্লেষণ

গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় স্মৃতিশক্তির উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন, REM (Rapid Eye Movement) ঘুম পদ্ধতিগত এবং আবেগপূর্ণ স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে NREM (Non-Rapid Eye Movement) ঘুমের গভীর পর্যায়গুলো তথ্য এবং ডেটার মতো ঘোষণামূলক স্মৃতিকে শক্তিশালী করার জন্য অপরিহার্য।

  • NREM ঘুমের প্রভাব: একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দুটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। একদলকে নতুন কিছু শেখার পর ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল, এবং অন্য দলকে জেগে থাকতে বলা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, যারা ঘুমিয়েছিল তারা অন্যদের তুলনায় ১৫-২০% বেশি তথ্য মনে রাখতে পেরেছে।
  • স্মৃতি ধারণের হার: রাতে পড়ার পর ঘুমালে স্মৃতি ধারণের হার প্রায় ৮০% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যেখানে দিনের বেলায় পড়ার পর সেই হার ৬০-৬৫% এর কাছাকাছি থাকে।

সুতরাং, গাণিতিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, রাতে পড়ার পর পর্যাপ্ত ঘুম স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

আপনার জন্য কোনটি সেরা?

আসলে, পড়াশোনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ‘সেরা’ সময় নেই। এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ, অভ্যাস এবং শারীরিক অবস্থার উপর।

  • আপনি যদি ‘মর্নিং পার্সন’ হন: তাহলে সকালে পড়াশোনা করাই আপনার জন্য ভালো।
  • আপনি যদি ‘নাইট আউল’ হন: তাহলে রাতে পড়াশোনা করলে আপনি বেশি উপকৃত হবেন।

তবে, যে সময়েই পড়ুন না কেন, কয়েকটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে:

  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো অত্যন্ত জরুরি।
  • নিয়মিত বিরতি: একটানা পড়াশোনা না করে প্রতি ৪৫-৫০ মিনিট পর ৫-১০ মিনিটের বিরতি নিন।
  • সুষম খাবার: স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার গ্রহণ করুন, যা মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সাহায্য করবে।
  • ব্যায়াম: নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, এটি মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।

সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQ)

  • প্রশ্ন: পরীক্ষার আগে কি রাত জেগে পড়া উচিত?
    • উত্তর: না, পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়া উচিত নয়। কারণ ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায় এবং পড়া মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • প্রশ্ন: দিনে কতক্ষণ পড়া উচিত?
    • উত্তর: এটি ছাত্রছাত্রীর বয়স, বিষয় এবং লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে। তবে, প্রতিদিন নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময় পড়াশোনা করা উচিত।
  • প্রশ্ন: স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য কোনো বিশেষ খাবার আছে কি?
    • উত্তর: হ্যাঁ, কিছু খাবার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। যেমন – ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত মাছ, বাদাম, আখরোট, ব্লুবেরি, ব্রোকলি, এবং ডার্ক চকোলেট।
  • প্রশ্ন: পড়া মনে রাখার সহজ উপায় কী?
    • উত্তর: পড়া মনে রাখার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে, যেমন – নিয়মিত রিভিশন করা, লিখে লিখে পড়া, ছবির মাধ্যমে মনে রাখার চেষ্টা করা, এবং গ্রুপ স্টাডি করা।

উপসংহার

সকালে বা রাতে, পড়াশোনার জন্য কোন সময়টি সেরা, তার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই। এটি নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিগত অভ্যাসের উপর। তবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, রাতে পড়ার পর পর্যাপ্ত ঘুম স্মৃতিশক্তিকে মজবুত করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সকালে মস্তিষ্ক সতেজ থাকায় নতুন কিছু শেখার জন্য আদর্শ। তাই, আপনার সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো একটি সময় বেছে নিতে পারেন। তবে, মনে রাখবেন, সাফল্যের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, নিয়মানুবর্তিতা এবং কঠোর পরিশ্রম।

About Author
Laboni Das

এখানে লাবনী দাশের জন্য একটি সম্ভাব্য Author Bio প্রস্তাব করছি: লাবনী দাশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান লেখিকা এবং সাংবাদিক, যিনি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমসাময়িক বিষয়ে লিখে থাকেন। তাঁর লেখায় সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ফুটে ওঠে। লাবনী নিয়মিত এই ওয়েবসাইটে প্রবন্ধ, গল্প ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।