গরু পাচার মামলায় এনামুল-অনুব্রতর জামিন: প্রশ্নের মুখে তদন্তকারী সংস্থা

Enamul Haq Anubrata Mandal Cattle Smuggling Bail: পশ্চিমবঙ্গের বিতর্কিত গরু পাচার কাণ্ডে অভিযুক্ত প্রধান আসামি এনামুল হক এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অনুব্রত মণ্ডলের জামিন লাভ করায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির ভূমিকা…

Chanchal Sen

 

Enamul Haq Anubrata Mandal Cattle Smuggling Bail: পশ্চিমবঙ্গের বিতর্কিত গরু পাচার কাণ্ডে অভিযুক্ত প্রধান আসামি এনামুল হক এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অনুব্রত মণ্ডলের জামিন লাভ করায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি দিল্লির রাউজ অ্যাভিনিউ কোর্ট অনুব্রত মণ্ডলকে জামিন দিয়েছে, যিনি এই মামলায় প্রায় দুই বছর ধরে তিহার জেলে বন্দি ছিলেন। এর আগে জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট তাকে সিবিআই মামলায় জামিন দিয়েছিল।

অন্যদিকে, এনামুল হকের জামিন আবেদনের উপর দিল্লি হাইকোর্ট সম্প্রতি রায় সংরক্ষণ করেছে। হক ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে জামিন পেয়েছিলেন। এই দুই প্রধান অভিযুক্তের জামিন লাভ করায় তদন্তকারী সংস্থাগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গরু পাচার কাণ্ডের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে যা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত। প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ গরু এই পথে পাচার হয়ে যায়। মূলত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এলাকা দিয়ে এই পাচার হয়ে থাকে। গঙ্গা, পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ইমামবাজার এলাকা এই পাচারের একটি প্রধান কেন্দ্র।

আর জি কর কাণ্ডে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নীরব, দলে ভাঙন শুরু?

তদন্তে উঠে এসেছে যে, এই পাচার চক্রে বিএসএফ, কাস্টমস, পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশ রয়েছে। সিবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মুর্শিদাবাদে বিএসএফ ২০,০০০ এরও বেশি গরু জব্দ করেছিল। কিন্তু বিএসএফের কিছু আধিকারিক জব্দ করা গরুর প্রজাতি ও সংখ্যা কম করে দেখিয়েছিলেন। এরপর কাস্টমস আধিকারিকরা নিলামে গরুর মূল্য কমিয়ে দেখিয়েছিলেন যাতে পাচারকারীরা কম দামে গরু কিনতে পারে।

অনুব্রত মণ্ডল এই পাচার চক্রের একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত। তার ব্যক্তিগত বডিগার্ড সাইগল হোসেন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত বলে অভিযোগ। ইডি জানিয়েছে, মণ্ডল এই পাচার থেকে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা অর্জন করেছেন।

এনামুল হক ছিলেন এই পাচার চক্রের অন্যতম প্রধান পরিচালক। তার মুর্শিদাবাদের অফিসে গরু জমা করা হত এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে পাচার করা হত। সীমান্তে বিএসএফের কিছু আধিকারিক রাত ১১টা থেকে ভোর ৩টার মধ্যে গরু পার করানোর সুযোগ করে দিতেন।

এই মামলায় অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডল এবং তার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মনীষ কোঠারিকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে[6]। সুকন্যা মণ্ডল সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই জামিন প্রদান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির ব্যর্থতাকেই তুলে ধরেছে। জনমত গবেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, “বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মণ্ডল জেল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এটি জনগণের কাছে ভুল বার্তা পাঠাবে যে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার পরও কয়েক বছর জেলে কাটালেই জামিন পাওয়া যায়। এটি দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করবে।”

দুই যুগের দুই নেতা: ইন্দিরা থেকে মোদী – নির্বাচনী ইতিহাসের অদ্ভুত সাদৃশ্য

তবে তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে বিজেপি সরকার রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

অনুব্রত মণ্ডলের জামিন প্রদানের সময় আদালত বলেছে, “প্রসিকিউটিং এজেন্সি বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করছে অভিযুক্তদের সম্পূর্ণ নথি না দিয়ে, যার ফলে আইনজীবীরা চার্জশিট নিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারছেন না।”

সুপ্রিম কোর্টও জুলাই মাসে মণ্ডলকে জামিন দেওয়ার সময় বলেছিল, “বিশাল চার্জশিট থেকে মনে হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় নেবে।”

এই জামিন প্রদানের ফলে বীরভূমের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। মণ্ডল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জেলার রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জেলা। শেখ কাজল নামে একজন নেতা শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন এবং মণ্ডলের অনেক ঘনিষ্ঠ নেতা প্রভাব হারিয়েছেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা মণ্ডলকে বীর সম্বর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলের একজন নেতা বলেছেন, “দাদা ফিরে এলে সব ঠিক করে দেবেন। তিনি জানেন তার অনুপস্থিতিতে কে কী করেছে।”

অন্যদিকে বিরোধী দলগুলি বলছে, জামিন পাওয়ায় মণ্ডলের নির্দোষিতা প্রমাণিত হয়নি। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “আমরা আশা করছি মমতা ব্যানার্জি দিল্লি গিয়ে অনুব্রত মণ্ডলকে বীর সম্বর্ধনা দেবেন। আমরা আরও আশা করছি তাকে আরও বড় পদে নিযুক্ত করা হবে, কারণ তৃণমূল কংগ্রেস মনে হয় অপরাধ ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার মাত্রা অনুযায়ী পদ দেয়।”

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবতা নাকি অলীক কল্পনা?

বাংলা কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায় বলেছেন, মণ্ডলের জামিন প্রদান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্য নেতারাও শীঘ্রই জেল থেকে মুক্তি পাবেন।

এই ঘটনাক্রম থেকে দেখা যাচ্ছে, গরু পাচার কাণ্ডের মত জটিল ও বহুমাত্রিক অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছে এই ঘটনা। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।