১৮টি বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু অবশেষে তাদের প্রথম আইপিএল ট্রফি জিতেছে। ২০২৫ সালের ৩ জুন আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে পাঞ্জাব কিংসকে ৬ রানে হারিয়ে RCB এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্বাদ পেয়েছে। বিরাট কোহলি এবং তার দলের জন্য এটি ছিল স্বপ্নের সাকার হওয়ার মতো একটি রাত, যেখানে হাজার হাজার ভক্তের বছরের পর বছরের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে।
১৮ বছরের অপেক্ষার অবসান
RCB এর এই জয় শুধু একটি ম্যাচের বিজয় নয়, বরং এটি ছিল একটি পুরো প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণের গল্প। ২০০৮ সালে আইপিএল যাত্রা শুরুর পর থেকে RCB তিনবার ফাইনালে পৌঁছেছিল – ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৬ সালে। কিন্তু প্রতিবারই তারা শেষ মুহূর্তে হেরে গিয়েছিল।
এই দীর্ঘ যাত্রায় দলে এসেছেন রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলে, ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মতো কিংবদন্তিরা। কিন্তু কেউই RCB কে সেই কাঙ্ক্ষিত ট্রফিটি এনে দিতে পারেননি। অনেক কাছে গিয়েও হার, ট্রোল আর মিমের বিষয় হয়ে ওঠা – এসবের মধ্য দিয়েই RCB এর ভক্তরা তাদের দলের পাশে থেকেছেন।
ফাইনালে RCB এর পারফরম্যান্স
ফাইনালের দিন পাঞ্জাব কিংসের অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার টস জিতে প্রথমে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন। RCB ব্যাটিং করতে নেমে প্রথমেই চাপে পড়ে যায়। ফিল সল্ট মাত্র ১৬ রান করে আউট হয়ে যান। তারপর ময়াঙ্ক আগরওয়াল ২৪ রান করেন এবং অধিনায়ক রাজত পাতিদার ২৬ রান সংগ্রহ করেন।
বিরাট কোহলি দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪৩ রান করলেও তিনি তার স্বাভাবিক গতিতে রান করতে পারেননি। ৩৫ বল খেলে তিনি ৪ৃ রান করেন। লিয়াম লিভিংস্টোন ২৫ এবং জিতেশ শর্মা ২৪ রান করে দলকে একটি প্রতিযোগিতামূলক স্কোরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। শেষ পর্যায়ে অর্শদীপ সিং তিনটি উইকেট নিয়ে RCB কে ১৯০ রানে গুটিয়ে দেন।
পাঞ্জাব কিংসের চেজ শুরু হয় ভালোভাবেই। প্রভসিমরান সিং এবং প্রিয়াংশু আর্য ভালো সূচনা দেন। কিন্তু জশ হ্যাজেলউড প্রিয়াংশুকে আউট করে দেন। এরপর একে একে পাঞ্জাবের ব্যাটসম্যানরা আউট হতে থাকেন। বিশেষভাবে ক্রুণাল পাণ্ড্যার বোলিং পাঞ্জাবের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। তিনি চার ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়ে দুটি উইকেট নেন।
মূল সাফল্যের কারণসমূহ
বোলিং আক্রমণের শক্তি
RCB এর এবারের সাফল্যের পেছনে তাদের দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণ অন্যতম কারণ। জশ হ্যাজেলউড এই টুর্নামেন্টে ২১টি উইকেট নিয়ে দলের প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি শুধু উইকেট নেননি, বরং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক খেলোয়াড়দের আউট করে দলকে এগিয়ে রেখেছেন।
সুযশ শর্মা এবং ক্রুণাল পাণ্ড্যার স্পিন বোলিং RCB এর জন্য একটি বড় সম্পদ হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে ফাইনালে ক্রুণাল পাণ্ড্যার ২/১৭ এর বোলিং ফিগার ছিল ম্যাচ জেতার অন্যতম কারণ। মধ্য ওভারগুলোতে পাঞ্জাবের ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলে তিনি ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের অবদান
ফাইনালে পৌঁছানোর জন্য অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। RCB এর দলে বিরাট কোহলির মতো বিশ্বকাপ বিজয়ী, ক্রুণাল পাণ্ড্যার মতো আইপিএল চ্যাম্পিয়ন এবং জশ হ্যাজেলউডের মতো আন্তর্জাতিক তারকারা ছিলেন। এই অভিজ্ঞতা চাপের মুহূর্তে দলকে স্থির রাখতে সাহায্য করেছে।
বিরাট কোহলি এই সিজনে ৬১৪ রান করে ৫৫.৮২ গড়ে ব্যাট করেছেন এবং আটটি অর্ধশতক করেছেন। তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দলের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে। ফিল সল্ট এবং ময়াঙ্ক আগরওয়ালের মতো ব্যাটসম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রান করেছেন।
অধিনায়কত্বের পরিবর্তন
রাজত পাতিদারের অধিনায়কত্ব RCB এর জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মাত্র ৩২ বছর বয়সী এই অধিনায়ক তার প্রথম বছরেই দলকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। তার নেতৃত্বে দল একটি নতুন চেতনা পেয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।
পাতিদারের অধিনায়কত্বের পরিসংখ্যান দেখলে তার সাফল্য স্পষ্ট হয়। ১৫টি ম্যাচে ১০টি জয়ের সাথে তার জয়ের হার ৬৬.৬৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে তিনি একজন সফল নেতা হিসেবে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
পরিসংখ্যানে RCB এর জয়
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে এই সিজনে মোট আটটি ম্যাচ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমে ব্যাট করা দল ছয়টি ম্যাচ জিতেছে, আর দ্বিতীয়ে ব্যাট করা দল জিতেছে মাত্র দুটি। প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ছিল ২১৯/৬। সবচেয়ে কম রান রক্ষা করে জয় ১৯৬ এবং সবচেয়ে বড় টার্গেট চেজ ২০৪।
RCB এই স্টেডিয়ামে ছয়টি ম্যাচ খেলে তিনটি জিতেছে, জয়ের হার ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে পাঞ্জাব কিংস সাতটি ম্যাচ খেলে পাঁচটি জিতেছে, জয়ের হার ৭১ শতাংশ। কিন্তু ফাইনালের দিন RCB তাদের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেয়।
এই জয়ের সাথে RCB দ্বিতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে আইপিএল এবং উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ দুটি ট্রফিই জিতেছে। এর আগে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস এই কীর্তি অর্জন করেছিল।
RCB এর এই ঐতিহাসিক জয় শুধু একটি ট্রফি জেতার গল্প নয়, বরং এটি অধ্যবসায়, বিশ্বাস এবং কখনো হাল না ছাড়ার এক অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনী। দীর্ঘ ১৮ বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে “ঈ সালা কাপ নামদে” স্লোগানের বাস্তবায়ন হয়েছে। এই জয় RCB এর ভক্তদের জন্য যেমন আনন্দের, তেমনি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উদাহরণ যে ধৈর্য এবং বিশ্বাস থাকলে সফলতা একদিন না একদিন আসবেই।