মণিপুরে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, আবারও সহিংসতার আগুনে পুড়ছে। সম্প্রতি, মেইতৈ সম্প্রদায়ের ছয়টি মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এই ঘটনাটি রাজ্যের মধ্যে চলমান জাতিগত সংঘাতের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান। রাজ্যের দুই প্রধান সম্প্রদায়—মেইতৈ এবং কুকি—এর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ২৫০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৬০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
মণিপুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মেইতৈ সম্প্রদায়ের সদস্যরা অভিযোগ করছে যে কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সদস্যদের অপহরণ করেছে এবং তাদের হত্যার পর মৃতদেহগুলো ফেলে দিয়েছে। এই ঘটনার পর, রাজ্যের রাজধানী ইমফালে বিক্ষোভকারীরা আইনপ্রণেতাদের বাড়িতে হামলা চালায় এবং ভাঙচুর করে। পুলিশ ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অস্থায়ী কারফিউ জারি করা হয়েছে।
জাতিগত সংঘাতের পটভূমি
মণিপুরের এই জাতিগত সংঘাতের মূল কারণ হল মেইতৈদের জন্য সংবিধান অনুযায়ী “শিডিউলড ট্রাইব” মর্যাদা দাবি করা। এই মর্যাদা পাওয়ার মাধ্যমে তারা সরকারি সুবিধা এবং সংরক্ষিত আসনের অধিকার পাবে। কিন্তু কুকি সম্প্রদায় এই দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, কারণ এটি তাদের অধিকার এবং অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।
২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এই সহিংসতা প্রথমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যরা মেইতৈদের দাবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, যা পরে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক ঘটনার বিশ্লেষণ
গত ১৭ নভেম্বর, ছয়টি মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। মেইতৈ সম্প্রদায়ের সদস্যরা দাবি করেছেন যে এই মৃতদেহগুলি কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা অপহৃত হয়েছিল। এ ঘটনার পর, ইমফালে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং আইনপ্রণেতাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গ্যাস ব্যবহার করে এবং আটজন আহত হয়।
রাজ্যের পরিস্থিতি এতটাই অস্থির যে কেন্দ্রীয় সরকার অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনও পর্যন্ত রাজ্যে আসেননি, যদিও বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীকে মণিপুর সফরের আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিসংখ্যান ও তথ্য
– **মৃত্যু সংখ্যা**: ২৫০+
– **বাস্তুচ্যুত মানুষ**: ৬০,০০০+
– **বাড়িঘর ও ধর্মীয় স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত**: ৪,৭৮৬ বাড়ি ও ৩৮৬ ধর্মীয় স্থাপনা
– **অস্ত্র চুরি**: ৪,৫০০+ অস্ত্র চুরি হয়েছে পুলিশ থেকে
এই সংখ্যাগুলি দেখাচ্ছে যে মণিপুরে সংঘর্ষ কতটা ব্যাপক এবং গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে স্থানীয় জনগণের জীবনে।
জাতিগত বিভাজন ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
মণিপুরে মেইতৈ ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সামাজিক বিভাজন রয়েছে। মেইতৈরা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং তারা ভ্যালিতে বাস করে, যেখানে তারা অধিকাংশ জনসংখ্যার অংশ। অন্যদিকে, কুকি জনগণ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং তারা পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে।
এই বিভাজন শুধু ধর্মীয় নয় বরং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও রয়েছে। মেইতৈদের উন্নত জীবনযাত্রা এবং কুকিদের মধ্যে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একটি গভীর অসন্তোষ তৈরি করেছে। এর ফলে উভয় পক্ষই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সমঝোতা না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে যদি দ্রুত কোনো সমাধান না পাওয়া যায় তবে রাজ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত শুরু হতে পারে।
রাজ্যের উন্নয়ন প্রকল্পগুলি স্থগিত হয়ে গেছে এবং স্থানীয় জনগণের জীবনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সুতরাং, সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং উভয় পক্ষকে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় নিয়ে আসা।
মণিপুরের জাতিগত সংঘাত একটি জটিল সমস্যা যা দীর্ঘদিন ধরে চলমান। এটি শুধুমাত্র স্থানীয় জনগণের জন্য নয় বরং সমগ্র ভারতের জন্য একটি উদ্বেগজনক বিষয়। সরকারকে অবশ্যই এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে মণিপুরে আবারও শান্তির পথে ফিরে আসতে পারে।