ভারতের শহরগুলিতে হকারদের উপস্থিতি একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। একদিকে তারা শহরের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, অন্যদিকে তাদের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি নগর পরিকল্পনা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। এই প্রতিবেদনে আমরা হকার উচ্ছেদের বিভিন্ন দিক এবং এর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
হকার উচ্ছেদের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে শহর সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার উদ্বেগ। অনেক শহর কর্তৃপক্ষ মনে করে যে অনিয়ন্ত্রিত হকিং শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে এবং পর্যটন শিল্পকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, মুম্বাইয়ের ধারাভি এলাকায় হকার উচ্ছেদ প্রকল্প শুরু হয়েছিল শহরের ভাবমূর্তি উন্নত করার লক্ষ্যে।
ট্রাফিক সমস্যা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের কারণ। দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই-এর মতো মহানগরীতে ফুটপাতে হকারদের উপস্থিতি প্রায়শই যানজটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 2019 সালে দিল্লি হাই কোর্ট একটি রায়ে উল্লেখ করেছিল যে হকারদের কারণে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এটি ট্রাফিক সমস্যা বাড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে হকারদের খাবার বিক্রি ও প্রস্তুতের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর নয় বলে অভিযোগ ওঠে। 2020 সালে কোভিড-19 মহামারীর সময় এই উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়, যখন অনেক শহরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য হকারদের সাময়িকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে, হকার উচ্ছেদের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। অনেক রাজনৈতিক দল হকারদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক হিসেবে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, 2023 সালে মুম্বাইয়ে যখন বৃহন্মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (BMC) হকার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে, তখন বিরোধী দলগুলি এর তীব্র সমালোচনা করে। তারা অভিযোগ করে যে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবিকার উপর আঘাত হানছে।
হকারদের জন্য জীবিকার হুমকি একটি বাস্তব সমস্যা। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্ট্রিট ভেন্ডরস অফ ইন্ডিয়া (NASVI) এর মতে, ভারতে প্রায় 1 কোটি স্ট্রিট ভেন্ডর রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই এই পেশায় দশকের পর দশক ধরে নিযুক্ত। তাদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ এবং সামাজিক সুরক্ষার আওতার বাইরে।
হকারদের অধিকার রক্ষার জন্য 2014 সালে ভারত সরকার স্ট্রিট ভেন্ডর্স (প্রোটেকশন অফ লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অফ স্ট্রিট ভেন্ডিং) আইন পাস করে। এই আইন হকারদের জন্য টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন, হকিং ও নন-হকিং জোন নির্ধারণ, এবং হকারদের নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করে। তবে, এই আইনের বাস্তবায়ন অনেক রাজ্যে ধীরগতিতে হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টও হকারদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 2010 সালে মহারাষ্ট্র একনাথ হিরামন ভস্কর বনাম মুনিসিপাল কর্পোরেশন অফ গ্রেটার মুম্বাই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে রাস্তায় ব্যবসা করা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। 2022 সালে কোর্ট আবারও নির্দেশ দেয় যে কোনো হকারকে উচ্ছেদ করা যাবে না যতক্ষণ না তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়।
তবে, আইনি সুরক্ষা সত্ত্বেও হকার উচ্ছেদ অব্যাহত রয়েছে। 2023 সালে দিল্লিতে ব্যাপক হকার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়। বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করে যে এই উচ্ছেদ আইন লঙ্ঘন করে করা হচ্ছে এবং হকারদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
এই জটিল সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত হকিং জোন স্থাপন, হকারদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প, এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা। উদাহরণস্বরূপ, অহমেদাবাদে ‘হকার এম্পাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লোকাল এন্টারপ্রাইজ’ (HELE) প্রকল্পের মাধ্যমে হকারদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কলকাতায় ‘হকার সংসদ’ নামে একটি সংগঠন হকারদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। তারা শহর কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে হকারদের জন্য নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।
সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
উপসংহারে বলা যায়, হকার উচ্ছেদ বনাম রাজনীতির এই সংঘাত সহজে মীমাংসা হওয়ার নয়। এটি শহর পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক নীতি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি জটিল সমন্বয়। সুষম সমাধানের জন্য সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, হকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে ঐক্যমত্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
[নোট: এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত তথ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে ভারত সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্ট্রিট ভেন্ডরস অফ ইন্ডিয়া (NASVI), এবং সংশ্লিষ্ট আদালতের রায়গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বা ঘটনা যাচাই করার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।]