Human rights trials Bangladesh: গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা সাত দিনের মধ্যে হাজির না হলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
এই নির্দেশনা আসে ১৭ জুন ২০২৫ তারিখে, যখন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অভিযুক্তরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী, তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে এবং মামলার পরবর্তী শুনানি ২৪ জুন নির্ধারিত হয়েছে।
ঘটনার পটভূমিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক সহিংসতা ও গণহত্যার অভিযোগ ওঠে। এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনগুলো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরাসরি উস্কানিমূলক বক্তব্য ও নির্দেশনার মাধ্যমে এসব অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রেখেছেন। তার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো ব্যাপক সহিংসতায় লিপ্ত হয়।
- আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানোর নির্দেশনা।
- নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা।
- নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সহযোগী বাহিনী ব্যবহার করে গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগ।
- অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধীদের শাস্তি না দেওয়া এবং ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ততা।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই মামলার তদন্তে ৮১ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, সিসিটিভি, ফরেনসিক প্রতিবেদন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন এবং সরকারি নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, অভিযুক্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান বর্তমানে দেশের বাইরে, সম্ভবত ভারতে অবস্থান করছেন। তাদের বাসা ও সম্ভাব্য অবস্থানগুলোতে অভিযান চালিয়েও গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ অবস্থায় আদালত প্রচলিত আইনে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১০(১) ধারার আওতায় সম্ভব।
এই মামলার আরেক আসামি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলছে। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, যিনি মামলার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, এ বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটলে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করে।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই মামলার শুনানি পরিচালনা করছেন। আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, অভিযুক্তরা নির্ধারিত সময়ে হাজির না হলে, তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে এবং রায়ও হতে পারে।
সার্বিকভাবে, এই মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিচারিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে এমন বিচার কার্যক্রম দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আদালতের এই পদক্ষেপ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষায় একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।