সম্প্রতি সিপিএম দলের আধিকারিক ফেসবুক পেজের প্রোফাইল পিকচার (ডিপি) থেকে ঐতিহ্যবাহী লাল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ড বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই কটাক্ষ শুরু করেছে, বিশেষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের দলের রং পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। লাল রং যে সিপিএমের পরিচয় ও আদর্শের প্রতীক, সেটি বাদ দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের এই সিদ্ধান্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সিপিএম সূত্রে জানা গেছে, দলের আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এর পিছনে গভীর রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে এখনও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য আসেনি।
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “সিপিএম যে লাল রং থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এটাই প্রমাণ করে তারা আদর্শ থেকে সরে আসছে। ২০১১ সালে রাজ্য সরকার থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকেই তাদের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন তো নিজেদের পরিচয়ের মূল প্রতীক থেকেও সরে আসছে।”
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা ও লোগোর রং পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি ত্রিবর্ণের পরিবর্তে নীল ও সাদা রঙের প্রেক্ষাপটে দলের প্রতীক ঘাসফুলকে কালো ও সাদায় রূপান্তরিত করেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “আমি বিজেপির রং পছন্দ করি না।”
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলির এই রং নিয়ে টানাপোড়েন অনেকটাই প্রতীকী। বিজেপি যেখানে কমলা (কেসরিয়া) রঙকে তাদের পরিচয় হিসেবে ব্যবহার করে, সিপিএম সেখানে লাল রঙের সাথে চিরকাল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তৃণমূল কংগ্রেস শুরুতে ত্রিবর্ণ ব্যবহার করলেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নীল-সাদায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা রাজ্যের সরকারি ভবন এবং অন্যান্য প্রকল্পগুলিতেও প্রতিফলিত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাল রং সিপিএমের কেবল একটি প্রতীক নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। লাল রঙকে বাদ দিয়ে সিপিএম হয়তো নতুন পরিচয় গড়তে চাইছে, কিন্তু এতে দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের যুব মুখ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের এই পদক্ষেপকে “আদর্শচ্যুতি” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪-এ আমরা আরও ভালো ফলাফল করব। অন্যদিকে সিপিএম নিজেদের পরিচয় থেকেই দূরে সরে যাচ্ছে।”
সিপিএমের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের ভিতরেও বিভক্তি রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। দলের একাংশ মনে করছেন, আধুনিকীকরণের নামে দলের মূল পরিচয় থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। আবার অন্য অংশের মতে, নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে এবং দলের ভাবমূর্তি আধুনিক করতে এই ধরনের পরিবর্তন জরুরি।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ভোটের শতকরা মাত্র কয়েক ভাগ পেয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল দেখেছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই রং পরিবর্তন তাদের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ হতে পারে।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা আমাদের আদর্শ ও লক্ষ্যে অটল আছি। শুধুমাত্র বাহ্যিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা যে ভ্রান্ত প্রচার চালাচ্ছে, তা হাস্যকর। জনগণ এসব বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে বিভ্রান্ত হবে না।”
বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে রং নিয়ে এই লড়াই নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সরকারি ভবন, রেলিং, ফ্লাইওভার সবকিছুতে নীল-সাদা রঙের প্রয়োগ করেছেন। এমনকি কলকাতা পুলিশের গাড়িও নীল-সাদা রঙে রঙ করা হয়েছে।
রাজ্যের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গিয়েছে8। উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রেও প্রাক্তন দলীয় সহকর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ডিজিপি রাজীব কুমারকে অপসারণ করে তাঁর জায়গায় বিবেক সাহাইকে নিয়োগ করেছে, যা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস “বিজেপির প্রতিফলন” বলে মন্তব্য করেছে। উল্লেখ্য, রাজীব কুমারকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে দেখা হয়।
দলের রং পরিবর্তন শুধু সৌন্দর্যবোধেরই বিষয় নয়, এর পিছনে রাজনৈতিক বার্তাও থাকে। সিপিএমের লাল রং বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন তৈরি করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আগামী দিনে এই ইস্যু নিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।