বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক ফারহান আখতার তার আগামী চলচ্চিত্র ‘১২০ বাহাদুর’-এর জন্য অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। লাদাখের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই সিনেমার শুটিং সম্পন্ন করেছেন তিনি। ১৯৬২ সালের রেজাং লা যুদ্ধের ভিত্তিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ভারতীয় সৈন্যদের বীরত্বগাথা তুলে ধরবে।
এই যুদ্ধ চলচ্চিত্রটি তৈরি করতে গিয়ে প্রযোজনা দল অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছে। লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় তাপমাত্রা প্রায়ই মাইনাস ৫ থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। একজন চলচ্চিত্র শিল্পের সূত্র জানিয়েছেন, “দলটি লাদাখে প্রায় ১ৄ হাজার ফুট উচ্চতায় শুটিং করেছে, এবং তাপমাত্রা প্রায়ই মাইনাস ৫, এমনকি কিছু দিন মাইনাস ১০ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল।”
ফারহান আখতার এই চলচ্চিত্রে মেজর শৈতান সিং ভাতির চরিত্রে অভিনয় করবেন, যিনি পরম বীর চক্র প্রাপ্ত একজন বীর সৈনিক ছিলেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময় রেজাং লা পাসে সংঘটিত এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে ১২০ জন ভারতীয় সৈন্য হাজারের বেশি চীনা সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
রেজাং লা যুদ্ধ ভারতীয় সামরিক ইতিহাসের এক গর্বজনক অধ্যায়। ১৮ নভেম্বর ১৯৬২ সালে, ১৩তম কুমায়ুন রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির ১২০ জন আহির সৈন্য মেজর শৈতান সিং ভাতির নেতৃত্বে প্রায় ৩ হাজার চীনা সৈন্যের বিরুদ্ধে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন। এই যুদ্ধে তারা নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিলেন, যদিও তারা জানতেন যে তাদের সাহায্য আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
‘১২০ বাহাদুর’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করছেন রজনীশ ‘রাজি’ ঘাই, যিনি পূর্বে কঙ্গনা রানাউতের ‘ধাকড়’ চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এক্সেল এন্টারটেইনমেন্টের ব্যানারে রিতেশ সিধবানি ও ফারহান আখতার, এবং ট্রিগার হ্যাপি স্টুডিওজের অমিত চন্দ্র এই চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করছেন।
শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে ফারহান আখতারকে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে এবং উচ্চ উচ্চতায় কাজ করার জন্য নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তিনি মেজর শৈতান সিং চরিত্রে অভিনয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ওজন কমিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রযোজনার একটি সূত্র জানিয়েছে, “উদ্দেশ্য ছিল সততার সাথে গল্পটিকে সম্মান জানানো, এবং ফারহান সত্যিই শারীরিক, মানসিক এবং আবেগীয়ভাবে সব কিছু দিয়েছেন।”
রেজাং লা যুদ্ধের ৬২তম বার্ষিকীতে ফারহান আখতার এই বীর সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি লিখেছেন, “১৯৬২ সাল থেকে ৬২ বছর হয়ে গেছে। আজ আমরা রেজাং লা-র বীরদের অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাচ্ছি। ১২০ বাহাদুর হল মেজর শৈতান সিং এবং তার সাহসী সৈন্যদের বীরত্ব ও অদম্য মনোভাবের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
এই যুদ্ধের গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে ফারহান আরও উল্লেখ করেছেন, “তাদের কাহিনী যুগ যুগ ধরে প্রতিধ্বনিত হয়, আমাদের স্বাধীনতার মূল্য এবং ঐক্যের শক্তি সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয়। আহির সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ সালাম, যাদের সন্তানরা আমাদের জাতিকে রক্ষায় অতুলনীয় সাহসিকতা প্রদর্শন করেছে।”
শিশুদের সাথে পড়ার জন্য সেরা ১০টি মজার ও আকর্ষণীয় বই: একটি
চলচ্চিত্রটির নির্মাণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল কারণ প্রযোজনা দলকে প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ তৈরি করতে হয়েছে। লাদাখের কঠিন ভূগোল, অত্যধিক উচ্চতা এবং হিমশীতল আবহাওয়া এই শুটিংকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে কাজ করা শুধুমাত্র অভিনেতাদের জন্যই নয়, পুরো কারিগরি দলের জন্যও অত্যন্ত কঠিন ছিল।
আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, এই যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে ইতিমধ্যে একটি ওয়েব সিরিজও নির্মিত হয়েছে। ২০২১ সালে ডিজনি+ হটস্টারে মুক্তি পেয়েছে ‘১৯৬২: দ্য ওয়ার ইন দ্য হিলস’, যেখানে অভয় দেওল প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মহেশ মাঞ্জরেকর পরিচালিত এই সিরিজটিও রেজাং লা যুদ্ধের কাহিনী তুলে ধরেছে, যেখানে ১২৪ জন ভারতীয় সৈন্য ৩ হাজার চীনা সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার গল্প বলা হয়েছে।
লাদাখ অঞ্চলটি ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত কঠিন একটি এলাকা। এই অঞ্চলের পর্বতশ্রেণী প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল যখন ভারতীয় প্লেট ইউরেশীয় প্লেটের সাথে সংঘর্ষে এসেছিল। লাদাখ রেঞ্জের শিখরগুলি জোজি-লা এর কাছাকাছি মাঝারি উচ্চতায় রয়েছে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বৃদ্ধি পায়। এই কঠিন ভূগোলেই ১৯৬২ সালের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
রেজাং লা যুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা অনুযায়ী, চীনা সেনারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও ভৌগোলিক সুবিধা ছিল। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদের ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং মাতৃভূমিকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প। এই যুদ্ধে প্রায় ১৩০০ চীনা সৈন্য নিহত হয়েছিল বলে জানা যায়।
চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন কঠিন পরিবেশে শুটিং করা অত্যন্ত বিরল। বলিউডে সাধারণত কঠিন আবহাওয়ায় শুটিং এড়ানো হয়, কিন্তু ‘১২০ বাহাদুর’-এর ক্ষেত্রে নির্মাতারা প্রকৃত পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছেন। এর আগে রানী মুখার্জী রাজস্থানের কোটায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ‘মর্দানি টু’ সিনেমার শুটিং করেছিলেন, কিন্তু মাইনাস ১০ ডিগ্রিতে শুটিং একটি অসাধারণ চ্যালেঞ্জ।
নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা: কেন পরিবর্তন করল সরকার?
এই চলচ্চিত্রটি ২১ নভেম্বর ২০২৫ সালে মুক্তি পাবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই তারিখটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রেজাং লা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৮ নভেম্বর ১৯৬২ সালে, তাই এই সময়েই সিনেমা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে সেই বীর সৈন্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
প্রতি বছর নভেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী চুশুলের কাছে রেজাং লা যুদ্ধ স্মৃতিসৌধে এই বীর সৈন্যদের স্মরণে সমাবেশ করে। এই যুদ্ধ সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে অতুলনীয় সাহসিকতার একটি উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে কাঁচা সাহস ও দেশপ্রেম প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।
ফারহান আখতারের এই সিনেমাটি শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ চলচ্চিত্র নয়, বরং এটি ভারতীয় সৈন্যদের আত্মত্যাগ এবং দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসার একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রযোজকদের মতে, এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য সেই বীর সৈন্যদের সাহস ও আবেগময় শক্তিকে তুলে ধরার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
‘১২০ বাহাদুর’ চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের দর্শকদের কাছে রেজাং লা যুদ্ধের অজানা কাহিনী তুলে ধরবে। এই সিনেমার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে সেই বীর সৈন্যদের সম্পর্কে, যারা মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। চরম প্রতিকূল পরিবেশে এই সিনেমার শুটিং সম্পন্ন করার মাধ্যমে ফারহান আখতার ও তার দল প্রমাণ করেছেন যে, শিল্পের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখাতে কোনো কষ্টই বড় নয়।