লালন সম্রাজ্ঞীর মহাপ্রয়াণ: সুরের জগৎকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন ফরিদা পারভীন

ঢাকা, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫: বাংলা লোকসংগীতের আকাশে এক ধূমকেতুর পতন। সুরের জাদুতে যিনি কয়েক দশক ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন কোটি শ্রোতাকে, সেই কিংবদন্তী শিল্পী, লালন সাঁইয়ের গানের সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন…

Avatar

 

ঢাকা, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫: বাংলা লোকসংগীতের আকাশে এক ধূমকেতুর পতন। সুরের জাদুতে যিনি কয়েক দশক ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন কোটি শ্রোতাকে, সেই কিংবদন্তী শিল্পী, লালন সাঁইয়ের গানের সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন আর নেই। আজ, শনিবার, ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত আনুমানিক সোয়া দশটায় ঢাকার মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।

শিল্পীর মৃত্যুর খবরটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। তাঁর জামাতা সাজ্জাদুর রহমান খানও সংবাদমাধ্যমকে এই দুঃসংবাদ জানান। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি কিডনির জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। সম্প্রতি তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। শেষ কয়েকদিন তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। অবশেষে সব লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। তাঁর এই মহাপ্রয়াণে দেশের সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রেখে গেছেন স্বামী, চার সন্তান এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী।

যে অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো

ফরিদা পারভীনের প্রয়াণ শুধু একজন শিল্পীর জীবনাবসান নয়, এটি বাংলা লোকসংগীতের, বিশেষ করে লালনগীতির একটি স্বর্ণযুগের সমাপ্তি। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘মিলন হবে কত দিনে’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’-এর মতো শত শত লালন সাঁইয়ের বাণীকে যিনি তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, তাঁর কণ্ঠ আজ স্তব্ধ। ফরিদা পারভীনের দরাজ ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ গায়কী লালনের দর্শনকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছিল এক অন্য মাত্রায়।

১৯৫৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্মগ্রহণকারী ফরিদা পারভীনের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল শৈশব থেকেই। যদিও তাঁর সংগীত জীবনের সূচনা হয়েছিল নজরুলসংগীত দিয়ে, কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতে তিনি লালন সাঁইয়ের দর্শনের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং সাধক মোকসেদ আলী শাহের কাছে লালনগীতিতে তালিম নিতে শুরু করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। লালনের গানই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান ও সাধনা।

সংগ্রাম ও সাধনার পথ

ফরিদা পারভীনের শিল্পী হয়ে ওঠার পথটি মসৃণ ছিল না। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারীর জন্য সংগীতকে পেশা হিসেবে নেওয়া ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু পরিবারের সমর্থন এবং নিজের ঐকান্তিক সাধনায় তিনি সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করেন। তাঁর গায়কীতে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুস্পষ্ট প্রভাব থাকলেও, তিনি মাটির সুরকে অবহেলা করেননি। বরং শাস্ত্রীয় জ্ঞান এবং লোকসংগীতের আবেগকে এক সুতোয় গেঁথে তিনি তৈরি করেছিলেন এক নিজস্ব গায়কী, যা তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে।

দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংগীত সাধনা করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে তিনি ছিলেন একজন নিয়মিত এবং জনপ্রিয় শিল্পী। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মঞ্চে তিনি লালনের গান গেয়ে জয় করেছেন শ্রোতাদের মন। তাঁর কণ্ঠে লালনের বাণী পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি।

অর্জন ও স্বীকৃতি

সংগীত জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ফরিদা পারভীন বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননাগুলোর মধ্যে অন্যতম “একুশে পদক” লাভ করেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে “জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার” অর্জন করেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৮ সালে তিনি জাপান সরকারের সম্মানজনক “ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ”-এ ভূষিত হন, যা এশিয়ার সংস্কৃতিতে অবদান রাখা ব্যক্তিদের প্রদান করা হয়। এছাড়াও দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে তিনি সম্মাননা পেয়েছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল শ্রোতাদের ভালোবাসা, যা তিনি আজীবন পেয়ে এসেছেন।

শেষ জীবনের লড়াই

জীবনের শেষ কয়েক বছর ফরিদা পারভীন শারীরিক অসুস্থতার সাথে লড়াই করছিলেন। কিডনির জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করলে তাঁকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হতো। এছাড়াও তিনি ফুসফুসের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ২রা সেপ্টেম্বর নিয়মিত ডায়ালাইসিসের জন্য তাঁকে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে আর ফেরানো সম্ভব হয়নি।

ফরিদা পারভীনের চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। লালনের দর্শনকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অচিন পাখি স্কুল’। তাঁর সুরের মধ্য দিয়ে, তাঁর জীবনের সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে। সুরলোকে চিরশান্তিতে থাকুন লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন।

About Author
Avatar

বাংলাদেশ প্রতিনিধি থেকে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য খবর পেতে আমাদের সংবাদ ওয়েবসাইট দেখুন। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের বিস্তারিত জানুন।