ফার্মের মুরগি খাওয়া: স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

Farmed chicken health risks: ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার চিকেন বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় একটি জনপ্রিয় আইটেম। কিন্তু এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। অনেকেই মনে করেন যে ফার্মের…

Debolina Roy

 

Farmed chicken health risks: ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার চিকেন বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় একটি জনপ্রিয় আইটেম। কিন্তু এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। অনেকেই মনে করেন যে ফার্মের মুরগি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আসুন জেনে নেই এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও গবেষণার ফলাফল।

ফার্মের মুরগির উৎপত্তি ও জনপ্রিয়তা

ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার চিকেন হল একটি বিশেষ প্রজাতির মুরগি যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং অল্প সময়ে বেশি মাংস উৎপাদন করে। এই ধরনের মুরগি পালন শুরু হয় ১৯২০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশে ১৯৮০ এর দশক থেকে ব্যাপকভাবে ব্রয়লার মুরগি চাষ শুরু হয়।ব্রয়লার মুরগির জনপ্রিয়তার কারণ:

ফার্মের মুরগি নিয়ে উদ্বেগের কারণ

ফার্মের মুরগি নিয়ে প্রধান উদ্বেগের কারণগুলি হল:

  1. অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার
  2. হরমোন ইনজেকশন
  3. কৃত্রিম খাদ্য
  4. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পালন
  5. ভারী ধাতুর উপস্থিতি

এই বিষয়গুলি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। আসুন দেখে নেই গবেষণার ফলাফল কী বলছে।

গবেষণার ফলাফল

অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) ২০২২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করে। এই গবেষণায় ব্রয়লার মুরগির মাংস, হাড়, কলিজা, কিডনি ও গিলায় অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।গবেষণার ফলাফল:

উপাদান পরিমাণ মন্তব্য
অ্যান্টিবায়োটিক (১০ ধরনের) সহনশীল মাত্রার চেয়ে কম নিরাপদ
ভারী ধাতু (৩ ধরনের) সহনশীল মাত্রার চেয়ে কম নিরাপদ

এই গবেষণার ভিত্তিতে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ব্রয়লার মুরগি খাদ্য হিসেবে নিরাপদ, এতে জনস্বাস্থ্যের কোনো ঝুঁকি নেই।”

হরমোন ইনজেকশন

অনেকে মনে করেন যে ব্রয়লার মুরগিকে দ্রুত বড় করার জন্য হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হল:

  • বাংলাদেশে মুরগিতে হরমোন ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ
  • হরমোন ইনজেকশন ব্যয়বহুল ও অকার্যকর পদ্ধতি
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত জাত ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার কারণেই ব্রয়লার মুরগি দ্রুত বড় হয়

ফার্মের মুরগির উপকারিতা

ফার্মের মুরগি খাওয়ার কিছু উপকারিতা রয়েছে:

  1. উচ্চ মানের প্রোটিন: ১০০ গ্রাম ব্রয়লার মাংসে প্রায় ২৭ গ্রাম প্রোটিন থাকে।
  2. পুষ্টি উপাদান: এতে ভিটামিন বি৬, নিয়াসিন, আয়রন, জিঙ্ক সহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে।
  3. সহজে হজম: ব্রয়লার মুরগির মাংস নরম হওয়ায় সহজে হজম হয়।
  4. সাশ্রয়ী মূল্য: দেশি মুরগির তুলনায় কম দামে পাওয়া যায়।

ফার্মের মুরগির সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক

যদিও সরকারি গবেষণা ব্রয়লার মুরগিকে নিরাপদ বলছে, তবুও কিছু বিশেষজ্ঞ এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্ক করেছেন:

  1. অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বাড়তে পারে।
  2. উচ্চ কোলেস্টেরল: ব্রয়লার মুরগিতে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় নিয়মিত খেলে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে।
  3. হরমোন ভারসাম্যহীনতা: যদিও হরমোন ইনজেকশনের প্রমাণ নেই, তবে কৃত্রিম খাদ্যের কারণে হরমোন ভারসাম্যহীনতা হতে পারে।
  4. ফুড পয়জনিং: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পালনের কারণে সালমোনেলা বা ক্যাম্পিলোব্যাক্টর জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

নিরাপদে ফার্মের মুরগি খাওয়ার উপায়

ফার্মের মুরগি নিরাপদে খাওয়ার জন্য কিছু পরামর্শ:

  1. বিশ্বস্ত উৎস থেকে কিনুন
  2. ভালোভাবে রান্না করুন (অন্তত ৭৫°C তাপমাত্রায়)
  3. সপ্তাহে ২-৩ দিনের বেশি না খাওয়া
  4. অন্যান্য প্রোটিন উৎসের সাথে সমন্বয় করুন (মাছ, ডিম, ডাল ইত্যাদি)
  5. স্কিন বা চর্বি অংশ বাদ দিন

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ভিন্ন মতামত দিয়েছেন:ডা. শর্মিষ্ঠা রায় দত্ত (পুষ্টিবিদ): “ব্রয়লার মুরগি সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়, তবে মাঝে মাঝে খেলে কোনো সমস্যা নেই। সপ্তাহে দুই-তিনদিন খাওয়া যেতে পারে।”
প্রফেসর ডা. আবুল হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়): “ব্রয়লার মুরগির মাংসে ক্রমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।”
ডা. মাহফুজা নাসরীন (পুষ্টিবিদ): “ফার্মের মুরগির মাংসে বিষাক্ত ক্রমিয়াম থাকে, যা কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করতে পারে।”

মুরগির লেগ নাকি ব্রেস্ট? জেনে নিন কোনটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য সেরা!


ফার্মের মুরগি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকারি গবেষণা এটিকে নিরাপদ বলে চিহ্নিত করেছে। তবে সতর্কতার সাথে ও পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। পাশাপাশি অন্যান্য প্রোটিন উৎস যেমন মাছ, ডিম, ডাল ইত্যাদির সাথে সমন্বয় করে খাওয়া ভালো। সর্বোপরি, নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কোনো সন্দেহ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।শেষ পর্যন্ত, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই সুস্থ থাকার মূল চাবিকাঠি। ফার্মের মুরগি খাওয়া বা না খাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সামগ্রিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনশৈলী।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।