Lord Jagannath chariot rope name: পুরীর রথযাত্রা মানেই লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়, উল্লাস আর ভক্তির মহামিলন। বিশাল তিনটি রথ রাজপথ ধরে এগিয়ে চলে, আর সেই রথকে টেনে নিয়ে যান অগণিত ভক্ত। এই রথ টানার জন্য যে বিশাল দড়ি ব্যবহার করা হয়, তাকে আমরা সাধারণ ভাষায় ‘রথের দড়ি’ বলেই জানি। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই দড়ি কেবল সাধারণ এক রশি নয়? এর একটি বিশেষ নাম ও পৌরাণিক তাৎপর্য রয়েছে। জগন্নাথ দেবের রথের দড়ির নাম হলো শঙ্খচূড় নাগিনী। পুরাণ মতে, এই রশি আসলে শঙ্খচূড় নামক এক শক্তিশালী সর্পের প্রতীক।
তিন রথের দড়ির ভিন্ন ভিন্ন নাম ও পরিচয়
জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা—এই তিন দেব-দেবীর জন্য তিনটি আলাদা রথ তৈরি করা হয় এবং প্রত্যেকটি রথের দড়িরও রয়েছে স্বতন্ত্র নাম ও তাৎপর্য। এই দড়িগুলি কেবল রথ টানার উপকরণ নয়, বরং এগুলি বিশেষ পৌরাণিক সত্তার প্রতীক।
- জগন্নাথ দেবের রথের দড়ি: জগন্নাথ দেবের রথ ‘নন্দীঘোষ’-এর দড়ির নাম শঙ্খচূড়া নাগিনী। পুরাণ অনুসারে, এই দড়িটি হলো শঙ্খচূড় নামের এক নাগিনীর প্রতীক। ভক্তরা যখন এই দড়ি ধরে টান দেন, তখন তাঁরা কেবল রথকেই নয়, বরং এই পৌরাণিক শক্তিকেও স্পর্শ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
- বলভদ্রের রথের দড়ি: বলরামের রথ ‘তালধ্বজ’-এর দড়ির নাম হলো বাসুকি নাগ। পৌরাণিক কাহিনীতে নাগরাজ বাসুকি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সমুদ্রমন্থনের সময় তাঁকে মন্থন দণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বলভদ্রের রথের দড়ি সেই শক্তিশালী নাগরাজ বাসুকির প্রতীক।
- সুভদ্রার রথের দড়ি: দেবী সুভদ্রার রথ ‘দর্পদলন’ বা ‘দেবদলন’-এর দড়ির নাম স্বর্ণচূড়া নাগিনী। এই নামটি এর সৌন্দর্য ও পবিত্রতার পরিচয় দেয়।
এই দড়িগুলি অত্যন্ত যত্ন সহকারে তৈরি করা হয়। সাধারণত নারকেল ছোবড়ার শক্তিশালী আঁশ দিয়ে এই দড়ি তৈরি হয়, যা প্রায় ৮ ইঞ্চি মোটা হতে পারে। এর শক্তি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হয় যাতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের টান এটি সহ্য করতে পারে।
শুধু দড়ি নয়, রথের প্রতিটি অংশই তাৎপর্যপূর্ণ
রথযাত্রার মাহাত্ম্য কেবল রথের দড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনটি রথের প্রতিটি অংশই গভীর আধ্যাত্মিক ও পৌরাণিক তাৎপর্যে পরিপূর্ণ। প্রতিটি রথেই তেত্রিশ কোটি দেবতা বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়, যা এই উৎসবকে এক অনন্য মাত্রা প্রদান করে।
রথের গঠন ও বৈশিষ্ট্য
পুরীর রথযাত্রার জন্য প্রতি বছর সম্পূর্ণ নতুন করে তিনটি রথ নির্মাণ করা হয়। এই নির্মাণশৈলী বংশপরম্পরায় চলে আসছে।
বৈশিষ্ট্য
জগন্নাথ দেবের রথ (নন্দীঘোষ)বলভদ্রের রথ (তালধ্বজ)সুভদ্রার রথ (দেবদলন)রথের নামনন্দীঘোষ বা গরুড়ধ্বজ তালধ্বজ বা লাঙ্গল ধ্বজ দর্পদলন বা দেবদলন
উচ্চতা
- ৪৪ ফুট ২ ইঞ্চি বা প্রায় ১৩.৫ মিটার
- ৪৩ ফুট ৩ ইঞ্চি বা প্রায় ১৩.২ মিটার,
- ৪২ ফুট ৩ ইঞ্চি বা প্রায় ১২.৯ মিটার
চাকার সংখ্যা: ১৬টি,১৪টি,১২টি
কাঠের টুকরো:
- ৮৩২টি
- ৭৬৩টি
- ৫৯৩টি
রং লাল ও হলুদ, লাল ও নীলাভ সবুজ, লাল ও কালো
সারথি: দারুক, মাতলি,অর্জুন
পতাকা: ত্রৈলোক্যমোহিনী,উন্নানি, নাদাম্বিকা
জগন্নাথ দেবের রথের ১৬টি চাকা চন্দ্রের ১৬টি কলার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়, যা একটি সম্পূর্ণ কালচক্রকে নির্দেশ করে। কথিত আছে, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র জগন্নাথ দেবকে ‘নন্দীঘোষ’ রথটি প্রদান করেছিলেন। ফাসি ও ধৌসা গাছের কাঠ দিয়ে এই রথগুলি তৈরি করা হয়, যা মহানদী দিয়ে পুরীতে নিয়ে আসা হয়।
রথের দড়ি টানার মাহাত্ম্য
ভক্তদের কাছে রথের দড়ি স্পর্শ করা বা তাতে টান দেওয়া এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়। বিশ্বাস করা হয়, জীবনে অন্তত একবার রথের দড়িতে টান দিতে পারলে পুণ্য অর্জন হয় এবং মানুষ সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি লাভ করে মোক্ষের পথে অগ্রসর হতে পারে।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতে, এর এক গভীর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি উপনিষদের শ্লোকের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু”। অর্থাৎ, এই মানব শরীরই হলো রথ আর তার ভেতরে থাকা আত্মাই হলেন রথী বা রথের মালিক। রথযাত্রার সময় জগন্নাথ দেবের রথ টানা আসলে নিজের আত্মাকে জাগতিক মায়া থেকে মুক্ত করে পরমাত্মার দিকে, অর্থাৎ মোক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতীকী রূপ6। ভক্তরা যখন সমস্ত পার্থিব চিন্তা ছেড়ে ভক্তিভরে রথের দড়ি টানেন, তখন তাঁরা আসলে নিজেদের আধ্যাত্মিক যাত্রাকেই এগিয়ে নিয়ে যান।
সুতরাং, জগন্নাথ দেবের রথের দড়ির নাম শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি বিশ্বাস, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিকতার এক গভীর প্রতীক। এই দড়ি স্পর্শ করার মাধ্যমে ভক্তরা কেবল একটি উৎসবের অংশ হন না, বরং নিজেদের জীবনকে সার্থক করার এক ঐশ্বরিক সুযোগ লাভ করেন।