প্রতি বছর ১৭ মার্চ বাংলাদেশে একটি বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রধান নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই দিনটি কেবল একটি জন্মবার্ষিকী নয়, বরং বাঙালি জাতির গৌরব ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে এই দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত এবং বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুনের চতুর্থ সন্তান হিসেবে তিনি জন্ম নেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী ও সংবেদনশীল। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি সমাজের দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন। ১৯৪০-এর দশকে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ধীরে ধীরে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যা আজও বিশ্বে একটি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে স্বীকৃত।
এই দিনটি উদযাপনের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শিশুদের জন্য বিশেষ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে হাজার হাজার মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন। এছাড়া, ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। দিনটি শুরু হয় সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, এই দিনে তাদের প্রতিষ্ঠাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রকাশ করে।
তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক জানলে বোঝা যায় কেন তিনি বাঙালির কাছে এত প্রিয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় তিনি পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তখন তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, যা বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। তাঁর এই সংগ্রামের পথে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। তবুও তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেও, তাঁর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর জীবন শুধু সংগ্রামের গল্প নয়, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি কৃষি, শিক্ষা ও অর্থনীতির উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতি ঘটে। এই দিনে তিনি এবং তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তবুও তাঁর আদর্শ ও স্বপ্ন আজও বাঙালির হৃদয়ে জীবিত।
এই জন্মবার্ষিকী শুধু একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে সাহস ও ত্যাগের মাধ্যমে একটি জাতি তার মর্যাদা ফিরে পেতে পারে। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় স্থান পেয়েছে, যা তাঁর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। তিনি কেবল বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর।
সর্বোপরি, ১৭ মার্চ আমাদের কাছে একটি প্রেরণার দিন। এই দিনে আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি না, বরং তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিই। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একজন মানুষ কীভাবে একটি জাতির ভাগ্য বদলে দিতে পারে। তাই এই দিনটি কেবল উদযাপনের নয়, চিন্তারও।