পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশে বালোচ বিদ্রোহীদের হামলার তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। গত দুই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কনভয় এবং একটি বাসে চালানো সশস্ত্র হামলা ও বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ৯৫ জন সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। প্রথমে কোয়েটা থেকে তাফতানগামী একটি সেনা কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা এবং তারপর একটি বাসে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাক সরকার ও সেনাবাহিনী যদিও নিহতের সংখ্যা অনেক কম বলে জানিয়েছে, বিদ্রোহীদের দাবি এই হামলায় তাদের সাফল্য অনেক বেশি।
ঘটনার বিবরণ শুরু হয় শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫। কোয়েটা থেকে তাফতানের দিকে যাওয়া পাক সেনার একটি কনভয়ে ভয়াবহ হামলা চালায় বালোচ বিদ্রোহীরা। সূত্রের খবর, এই কনভয়ে সাতটি বাস ও দুটি গাড়ি ছিল। হামলাকারীরা প্রথমে একটি আইইডি বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি দিয়ে একটি বাসে ধাক্কা মারে, যা সম্ভবত আত্মঘাতী হামলা ছিল। এরপর রকেট-চালিত গ্রেনেড (আরপিজি) দিয়ে কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। বালোচ লিবারেশন আর্মির মাজিদ ব্রিগেড এই হামলার দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, নোশকির আরসিডি হাইওয়েতে রাখশান মিলের কাছে এই আক্রমণ চলে। তাদের দাবি, একটি বাস সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আরেকটি বাসকে ঘিরে ফেলে মোট ৯০ জন পাক সেনাকে হত্যা করা হয়েছে। পরদিন, রোববার ১৬ মার্চ, আরেকটি ঘটনায় একটি সেনা বাসে বোমা বিস্ফোরণে আরও ৫ জন সেনার মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। পাক প্রশাসন জানিয়েছে, এই দুই হামলায় ৭ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন, তবে বিএলএ-এর দাবি সরকারি তথ্যের সঙ্গে মিলছে না।
এই হামলার পর পাক সেনা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। আহতদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছে এবং ড্রোন দিয়ে এলাকায় নজরদারি চলছে। বালোচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেছে। বিএলএ জানিয়েছে, তারা শিগগিরই এই হামলার আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে। এর আগে, ১১ মার্চ জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন অপহরণের ঘটনায়ও বিএলএ জড়িত ছিল। সেই ঘটনায় ৩৪৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হলেও ২৮ জন সেনা নিহত হয়েছিলেন। গত কয়েক দিনে এই ঘটনাগুলো বালোচিস্তানের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
বালোচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। গ্যাস, কয়লা, তামা ও সোনার মতো সম্পদ এখানে প্রচুর। কিন্তু বালোচ জাতীয়তাবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই সম্পদ লুট করছে এবং স্থানীয়দের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পের পর এই অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। বিএলএ-এর মতো গোষ্ঠী মনে করে, এই প্রকল্পে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে বালোচদের শোষণ করছে। তারা স্বাধীনতার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। ২০০৪ সাল থেকে বিএলএ পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত।
এই ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের জন্যও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বালোচিস্তানে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায়ই বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। স্থানীয়রা বলছেন, এই লড়াইয়ে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। পাক সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিশ্লেষকদের মতে, বালোচদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার না দেওয়া পর্যন্ত এই অস্থিরতা কমবে না। বর্তমানে পাক সেনা পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে, তবে বিদ্রোহীরা আরও হামলার হুমকি দিয়েছে।
সাম্প্রতিক এই হামলাগুলো বালোচিস্তানের সংকটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একদিকে সরকার দাবি করছে তারা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্রোহীদের আক্রমণের ধারাবাহিকতা বলছে ভিন্ন কথা। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। সাধারণ মানুষ শান্তি চাইলেও, সংঘাতের আগুন সহজে নিভবে বলে মনে হচ্ছে না।