বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস: ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায় যা জানা প্রয়োজন

স্টাফ রিপোর্টার 6 Min Read

First novel of Bengali Literature: উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন বিপ্লব ঘটে। ছন্দবদ্ধ কাব্য আর ধর্মীয় আখ্যানের পাশাপাশি জন্ম নেয় একদম নতুন এক সাহিত্যরূপ—উপন্যাস। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস কোনটি? এই প্রশ্নটি আজও সাহিত্য গবেষকদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দেয়। কেউ বলেন ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’, কেউ মনে করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ই প্রথম। আবার অনেকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’কে প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

আজকের এই লেখায় আমরা জানবো এই বিতর্কের পেছনের সত্য। কোন বইটি আসলে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস? কারা এই পথপ্রদর্শক লেখক? এবং কেনই বা এত বিতর্ক এই বিষয়ে?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেরা ১০ উপন্যাস

প্রথম দাবিদার: ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ (১৮৫২)

অবাঙালির হাতে বাংলা সাহিত্যের সূচনা

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হয় হানা ক্যাথরিন মুলেন্স নামের এক সুইস মহিলার কথা দিয়ে। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ নামক গ্রন্থটিকে অনেক সাহিত্য বিশেষজ্ঞ বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা দেন।

হানা ক্যাথরিন মুলেন্স (১৮২৬-১৮৬১) ছিলেন একজন খ্রিস্টান মিশনারি ও শিক্ষাবিদ। তার বাবা আলফোনস ফ্রাঁসোয়া ল্যাক্রোয়া ১৮২১ সালে চিনসুরায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। হানা বাংলায় এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন যে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাংলা শেখানো শুরু করেন।

বইটির বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব

‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ মূলত খ্রিস্টান নারীদের জন্য লেখা হয়েছিল। বইটি প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশের ছয় বছর আগে প্রকাশিত হয়। তবে অনেক সমালোচক এটিকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস না বলে গল্প বা কাহিনী বলে মনে করেন।

দ্বিতীয় দাবিদার: ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮)

বাঙালির হাতে রচিত প্রথম উপন্যাস

প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর, রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙালি লেখকের হাতে রচিত প্রথম উপন্যাস। ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে।

বিপ্লবী ভাষারীতি: আলালী ভাষা

এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল চলতি বাংলা বা কথ্য ভাষার ব্যবহার। তৎকালীন সময়ে যখন সাহিত্যে সংস্কৃতবহুল ভাষার প্রাধান্য ছিল, প্যারীচাঁদ মিত্র সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় লিখলেন তার উপন্যাস। এই ভাষারীতি ‘আলালী ভাষা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

সামাজিক দর্পণ হিসেবে উপন্যাস

‘আলালের ঘরের দুলাল’ ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সমাজচিত্র তুলে ধরে। মূল চরিত্র মতিলালের চরিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন পশ্চিমাভিমুখী বাঙালি যুবসমাজের ভুল-ভ্রান্তি, অসংযম ও অপব্যয়ের চিত্র ফুটে ওঠে।

তৃতীয় দাবিদার: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)

প্রথম সার্থক উপন্যাসের খ্যাতি

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক এবং প্রামাণিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। ইউরোপীয় ধাঁচে রচিত এই উপন্যাসে উপন্যাসের সমস্ত বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে বিদ্যমান।

ঐতিহাসিক রোমান্স

ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোগল ও পাঠানদের সংঘর্ষের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাস। প্রেম, সাহসিকতা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মিশ্রণে তৈরি এই কাহিনী বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করে।

পাঠকপ্রিয়তা ও প্রভাব

‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের পর বাংলা পাঠকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই উপন্যাসের তেরোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ইংরেজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়ও অনূদিত হয়।

অন্যান্য দাবিদার গ্রন্থসমূহ

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান

‘কলিকাতা কমলালয়’ (১৮২৩), ‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৫) প্রভৃতি গ্রন্থও বাংলা উপন্যাসের প্রারম্ভিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এগুলো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে না বলে মনে করা হয়।

প্রথম নারী ঔপন্যাসিক

স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক। তার রচিত ‘দীপনির্বাণ’ (১৮৭৬) বাংলা নারী লেখকের প্রথম উপন্যাস।

বিতর্কের কারণ ও বিশ্লেষণ

উপন্যাসের সংজ্ঞার জটিলতা

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ হলো উপন্যাসের সংজ্ঞা নির্ধারণের জটিলতা। কোন বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে একটি গ্রন্থ উপন্যাস হিসেবে গণ্য হবে, সে বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

ভাষাগত বিবেচনা

‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ যদিও বাংলায় লেখা, কিন্তু লেখক অবাঙালি। অনেকে মনে করেন, বাঙালির হাতে রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ই প্রকৃত অর্থে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।

সাহিত্যিক মানের প্রশ্ন

‘দুর্গেশনন্দিনী’কে প্রথম সার্থক উপন্যাস বলার কারণ হলো এতে উপন্যাসের সমস্ত শিল্পগুণ ও কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।

বাংলা উপন্যাসের পরবর্তী বিকাশ

রবীন্দ্রনাথ থেকে আধুনিক যুগ

বঙ্কিমচন্দ্রের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের হাতে বাংলা উপন্যাস নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি

বিংশ শতাব্দীর বিপ্লব

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হুমায়ূন আহমেদের হাতে বাংলা উপন্যাস সকল বিদেশী প্রভাব কাটিয়ে স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত হয়। তার সরল ভাষা ও সংলাপপ্রধান রচনাশৈলী বাংলা উপন্যাসে নতুন মাত্রা যোগ করে।

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত

আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস নিয়ে বিতর্ক একটি সমৃদ্ধ আলোচনা। প্রতিটি গ্রন্থেরই নিজস্ব ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ কালক্রমের দিক থেকে প্রথম, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙালির হাতে রচিত প্রথম, আর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ শিল্পগুণে প্রথম সার্থক উপন্যাস।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস নিয়ে এই বিতর্ক আসলে আমাদের সাহিত্যের ঐশ্বর্যের প্রমাণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যে উপন্যাস ধারার সূচনা হয়েছিল, তা আজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা। হানা ক্যাথরিন মুলেন্স, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র—এঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবদানে বাংলা উপন্যাসের ভিত্তি রচনা করেছেন। আর সেই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলা উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে।এই ইতিহাস জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য ও গর্বের বিষয়। প্রতিটি যুগে বাংলা উপন্যাস নতুন রূপে, নতুন চেতনায় পাঠকদের সামনে হাজির হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হাজির হবে।

Share This Article