পাহালগামের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বুধবার (২৩ এপ্রিল, ২০২৫) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির (CCS) বৈঠকে এই সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছে। সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, সন্ত্রাসী হামলার সীমান্ত-পারের যোগাযোগ স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা হয়েছে।
পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পটভূমি
জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২০২৫) সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিকসহ মোট ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন। এই হামলা বাইসারান উপত্যকায় ঘটে, যেখানে সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায। এছাড়া আরও ১৭ জন আহত হয়েছেন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নাগরিকদের উপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই হামলার দায় দাবি করেছে “দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” (TRF), যা নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন লশকর-ই-তাইবার সাথে সম্পর্কিত বলে জানা যায়। সরকারি বিবৃতি অনুসারে, এই হামলা জম্মু-কাশ্মীরে সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছে1।
প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে CCS বৈঠক
হামলার খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরবে তাঁর দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার সকালে দিল্লি ফিরে আসেন। ফিরে এসেই তিনি ৭, লোক কল্যাণ মার্গে নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির (CCS) বৈঠক আহ্বান করেন। এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে CCS-কে জানানো হয় যে, পাহালগামের হামলার সীমান্ত-পারের যোগসূত্র স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্র সাংবাদিকদের জানান, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির পাকিস্তানি গভীর রাষ্ট্রের সাথে সংযোগ রয়েছে এবং তাদের সমর্থনে এই ধরনের তৎপরতা চালানো হয়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ
CCS বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
১. সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত
১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করা হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু নদী ব্যবস্থা থেকে প্রতি বছর ৩৯ বিলিয়ন ঘনমিটার জল পাকিস্তানকে দেওয়া হত। পাকিস্তান সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ না করা পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তি দীর্ঘকাল ধরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের একটি মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।
২. অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ
ভারত অবিলম্বে অটারি ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে এই রুট দিয়ে সকল সীমান্ত-পার চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, যার মধ্যে মানুষ ও পণ্যের আনাগোনাও অন্তর্ভুক্ত। যারা ইতিমধ্যে বৈধ নথি সহ সীমান্ত পার করেছেন, তাদের ১ মে, ২০২৫ তারিখের মধ্যে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হবে। এই প্রধান স্থল পারাপারের পথ বন্ধ করে দেওয়া সীমান্ত-পার চলাচল সীমিত করার এবং পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
৩. পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা বাতিল
ভারত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC (South Asian Association for Regional Cooperation) ভিসা এক্সেম্পশন স্কিম (SVES) বাতিল করেছে। পূর্বে জারি করা সমস্ত SVES ভিসা বাতিল বলে গণ্য করা হয়েছে। তদুপরি, যেসব পাকিস্তানি নাগরিক বর্তমানে এই স্কিমের অধীনে ভারতে আছেন, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার কঠোর সময়সীমা দেওয়া হয়েছে।
৪. পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার
ভারত নয়াদিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনের সমস্ত পাকিস্তানি সামরিক, নৌ, ও বিমান উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে। এই কর্মীদের ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (অবাঞ্ছিত ব্যক্তি) ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ভারতও ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশনে নিযুক্ত নিজের সামরিক উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করবে।
৫. কূটনৈতিক কর্মী সংখ্যা হ্রাস
দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক সংকুচিত করার অংশ হিসেবে, ভারত পাকিস্তানে ভারতীয় হাই কমিশনের সামগ্রিক শক্তি কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামাবাদে কূটনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বর্তমান ৫৫ থেকে কমিয়ে ১ মে, ২০২৫ তারিখের মধ্যে ৩০ করা হবে। এই হ্রাস দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সুযোগ আরও সীমিত করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পাহালগামের সন্ত্রাসী হামলা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্সের ভারত সফরের সময় এই ঘটনা ঘটে, এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং EU কমিশনের অধ্যক্ষ উরসুলা ডার লেয়েন সহ বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ভারতীয় জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি এই অঞ্চলে প্রাণহানির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে এই সহিংসতা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে, যেখানে অনেকেই কাশ্মীরের চলমান সংঘাতের জন্য পাকিস্তানের জড়িত থাকাকে দায়ী করছেন।
পাহালগাম হামলার পর সুরক্ষা ব্যবস্থা
হামলার পর এলাকায় সুরক্ষা ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী হামলাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য অভিযান শুরু করেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, “হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শুধু চিহ্নিত করা হবে না, বরং যারা আমাদের মাটিতে এই জঘন্য কাজের পরিকল্পনা করেছে তাদেরও চিহ্নিত করা হবে।”
শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে, এলাকায় টহল দেওয়া এবং অতিরিক্ত চেকপোস্ট স্থাপন করার জন্য হাজার হাজার নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। প্রাক্তন জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এবং এই চেকপয়েন্টগুলিতে গাড়ি পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে বিভাজনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় জটিল ছিল। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ এবং সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এই আক্রমণটি কাশ্মীর বিবাদের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাগুলির একটি, যা মূলত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত একটি অঞ্চল।
২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করার পর, যা পূর্বে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের অনন্য সুবিধা প্রদান করেছিল, কাশ্মীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচন এবং উন্নয়নের পথে অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে এই হামলা ঘটেছে বলে সরকার মনে করছে।
সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের প্রভাব
১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি দীর্ঘকাল ধরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি বিরল দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু, ঝেলাম ও চিনাব নদীর জল পাকিস্তানকে এবং রাভি, ব্যাস ও সতলজ নদীর জল ভারতকে বরাদ্দ করা হয়েছিল।
এই চুক্তি স্থগিত করার অর্থ হল পাকিস্তান বর্তমানে প্রাপ্ত ৩৯ বিলিয়ন ঘনমিটার জলের অংশ হারাতে পারে, যা দেশটির কৃষি ও অর্থনীতির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
পাহালগামের সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ভারতের গৃহীত এই পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিদেশ মন্ত্রক জোর দিয়ে বলেছে যে, পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভারত অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
এই পদক্ষেপগুলি দেখায় যে, ভারত সরকার সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আরও কঠোর অবস্থান নিতে প্রস্তুত। আগামী দিনগুলিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ হবে।