পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন মোড় নিতে চলেছে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম বা আইএমআইএম) এবার রাজ্যের সব বিধানসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছে। দলটির নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি মনে করছেন, বাংলার মুসলিম ভোটারদের সমর্থন পেলে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) ভোট ব্যাঙ্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ, এবং এই সম্প্রদায়ের ভোট অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইএমআইএম-এর এই সিদ্ধান্ত রাজ্য রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আইএমআইএম-এর এই সিদ্ধান্ত আসলে নতুন নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা বাংলায় প্রথমবার প্রার্থী দিয়েছিল, যদিও সাফল্য তেমন মেলেনি। তবে এবার দলটি আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানিয়েছেন, “বাংলার মুসলিমরা উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। তৃণমূল সরকার তাদের শুধু ভোটের জন্য ব্যবহার করে, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কিছুই করে না। আমরা তাদের জন্য লড়তে চাই।” তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনে রাজ্যের ২৯৪টি আসনেই প্রার্থী দেবে আইএমআইএম। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলটি ইতিমধ্যেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রচার জোরদার করছে।
গত কয়েক মাসে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের মতো জেলাগুলোতে আইএমআইএম-এর সভা ও সমাবেশে ভিড় বাড়ছে। দলটির দাবি, তৃণমূলের শাসনে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, চাকরি, এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উন্নতি হয়নি। তারা এই অভিযোগকে সামনে রেখে ভোটারদের কাছে পৌঁছতে চাইছে। অন্যদিকে, তৃণমূলের নেতারা আইএমআইএম-এর এই পদক্ষেপকে “ভোট কাটার” কৌশল হিসেবে দেখছেন। তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম বলেন, “ওয়াইসি বাংলায় এসে শুধু বিজেপির সুবিধা করে দেবে। আমরাই মুসলিমদের জন্য কাজ করেছি।”
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটের গুরুত্ব অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্পষ্ট। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলিম, এবং কিছু জেলায় এই সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি। মুর্শিদাবাদ (৭০.২৮%), মালদহ (৫১.২৭%), এবং উত্তর দিনাজপুর (৪৯.৯২%) এর মতো জেলাগুলোতে মুসলিম ভোটাররা ফলাফলের নিয়ামক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আইএমআইএম যদি এই ভোটের একটি অংশও কাটতে পারে, তাহলে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির লড়াই আরও জমে উঠতে পারে।
এছাড়া, আইএমআইএম-এর অন্য রাজ্যে সাফল্যও বাংলায় তাদের আশা বাড়িয়েছে। বিহারে ২০২০ সালের নির্বাচনে তারা ৫টি আসন জিতেছিল, এবং মহারাষ্ট্রের স্থানীয় নির্বাচনেও ভালো ফল করেছে। বাংলায় তাদের লক্ষ্য শুধু মুসলিম ভোট নয়, দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের সমর্থনও পাওয়া। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলার ভোটাররা ঐতিহ্যগতভাবে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে বিভক্ত। সেখানে আইএমআইএম-এর জন্য জায়গা করে নেওয়া সহজ হবে না।
এই ঘটনা বাংলার রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে? সোজা কথায়, আইএমআইএম যদি মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ নিজের দিকে টানতে পারে, তাহলে তৃণমূলের জেতা কঠিন হয়ে যেতে পারে। কারণ, অনেক আসনে তৃণমূলের জয় মুসলিম ভোটের ওপর নির্ভর করে। আবার, ভোট ভাগাভাগি হলে বিজেপি লাভবান হতে পারে। তবে আইএমআইএম-এর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের সংগঠন আর প্রচারের ওপর। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে তাদের শক্তিশালী কাঠামো নেই, যা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ মনে করছেন, নতুন দল এলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং উন্নয়নের কাজে গতি আসবে। কিন্তু অনেকে আবার বলছেন, এতে শুধু ভোট বিভক্ত হবে, আর কিছু নয়।
আইএমআইএম-এর এই পরিকল্পনা বাংলার রাজনীতিতে একটা বড় পরীক্ষা। তারা যদি সফল হয়, তাহলে রাজ্যে ত্রিমুখী লড়াই দেখা যেতে পারে। কিন্তু এখনই কিছু বলা মুশকিল, কারণ ভোটারদের মন জয় করা সহজ কাজ নয়। আগামী দিনে তাদের প্রচার আর কৌশলই ঠিক করবে, বাংলায় তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।
মন্তব্য করুন