আধুনিক জীবনযাত্রার চাপে আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাঙ্কফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার আর অনিয়মিত জীবনযাপনের ফলে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। কিন্তু আশার কথা হলো, লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না ৩ ধরনের খাবার রয়েছে যা নিয়মিত খেলে আপনার লিভার থাকবে সুস্থ ও কর্মক্ষম। এইমসের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ডা. সৌরভ শেট্টির পরামর্শ অনুযায়ী, তিনটি বিশেষ খাবার গ্রুপ আপনার লিভারকে ফ্যাট জমা থেকে বাঁচাতে পারে এবং এর স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
কেন বাড়ছে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা?
লিভার আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বিপাক ক্রিয়া, প্রোটিন সংশ্লেষণ, খাবার হজম এবং ভিটামিন সঞ্চয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা NAFLD (নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ) এখন বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই রোগে লিভারের কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়, যা লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে।
ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণগুলো:
-
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা
-
টাইপ ২ ডায়াবেটিস
-
উচ্চ কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড
-
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও চিনিযুক্ত খাদ্যের অতিরিক্ত সেবন
-
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না ৩ ধরনের খাবার – চিকিৎসকের পরামর্শ
এইমস এবং হার্ভার্ডে প্রশিক্ষিত গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ডা. সৌরভ শেট্টি তিনটি বিশেষ খাবার গ্রুপের কথা বলেছেন যা লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না। এই খাবারগুলো নিয়মিত সেবন করলে লিভারের স্বাস্থ্য বজায় থাকবে এবং ফ্যাট জমার প্রক্রিয়া বন্ধ হবে।
১. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পানীয়: কফি, গ্রিন টি ও মাচা
প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে বিশেষ কিছু পানীয় যা লিভারের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কালো কফি, গ্রিন টি এবং মাচা পরিমিত পরিমাণে সেবন করলে লিভার ভালো থাকে এবং মেদ জমে না।
কালো কফির উপকারিতা:
-
ক্যাফিন ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রয়েছে
-
প্রদাহনাশক উপাদান ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভার সুরক্ষা করে
-
লিভার এনজাইমের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে
গ্রিন টি ও মাচার বিশেষত্ব:
-
প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে
-
লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে
-
লিভারের চর্বি ও প্রদাহ কমায়
গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা: এই পানীয়গুলো অবশ্যই চিনি ছাড়া এবং পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে, তবেই সর্বোচ্চ উপকার পাওয়া যাবে।
২. প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি: হলুদ
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হলো হলুদ, যা আমাদের ভারতীয় রান্নাঘরে নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। ডাল থেকে তরকারি – সব খাবারেই হলুদের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।
হলুদের লিভার-বান্ধব গুণাবলী:
-
কারকিউমিন নামক শক্তিশালী উপাদান রয়েছে
-
অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে শরীর সুস্থ রাখে
-
প্রদাহ-বিরোধী ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে
-
পিত্তের উৎপাদন বাড়িয়ে হজম ও লিভার ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে
সেবনের পরিমাণ: প্রতিদিন আধা থেকে এক চামচ হলুদ ডায়েটে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। এটি লিভারের ক্ষতিকর এনজাইমের মাত্রা কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর।
৩. ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজি ও ফল
তৃতীয় ক্যাটাগরিতে রয়েছে বিশেষ কিছু সবজি ও ফল যা লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না। এর মধ্যে রয়েছে বেরি জাতীয় ফল, ব্রকোলি এবং বিট।
ব্রকোলির অসাধারণ গুণ:
-
প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে
-
ফ্যাটের পরিমাণ খুবই কম বা নেই বললেই চলে
-
সালফোরাফেন নামক উপাদান লিভার থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে
বিটের বিশেষত্ব:
-
প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে
-
বিটেলেন্স নামক উপাদান লিভার ভালো রাখতে সহায়ক
-
লিভারের চর্বি কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর
বেরি জাতীয় ফলের উপকারিতা:
-
স্ট্রবেরি, ব্লুবেরিতে প্রচুর ফাইবার রয়েছে
-
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থে ভরপুর
-
লিভার সুরক্ষা করে এবং মেদ জমতে দেয় না
অন্যান্য লিভার-বান্ধব খাবার
উপরোক্ত তিনটি প্রধান গ্রুপ ছাড়াও আরও কিছু খাবার রয়েছে যা লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী:
চর্বিযুক্ত মাছ
স্যামন, টুনা, সার্ডিন এবং ম্যাকেরেলে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। এই মাছগুলো লিভারের চর্বি কমাতে, প্রতিরক্ষামূলক HDL কোলেস্টেরল বাড়াতে এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
বাদাম ও বীজ
বাদাম, আখরোট এবং সূর্যমুখীর বীজে থাকা অসম্পৃক্ত চর্বি প্রদাহ ও লিভারের চর্বি কমাতে সক্ষম। ভিটামিন ই-এর মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
রসুন
রসুনে সেলেনিয়াম থাকে যা লিভারের এনজাইমগুলিকে সক্রিয় করে টক্সিন দূর করে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপ অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে লিভারকে রক্ষা করে।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না এমন খাবার খাওয়ার পাশাপাশি কিছু খাবার সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে:
ভাজা ও তৈলাক্ত খাবার
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, চিপস, সিঙ্গাড়া ইত্যাদিতে প্রচুর অস্বাস্থ্যকর ট্রান্স ফ্যাট থাকে যা লিভারে চর্বি জমার পরিমাণ বাড়ায়।
চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয়
সোডা, চকোলেট, মিল্কশেক এবং চিনিযুক্ত পানীয়তে হাই-ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ থাকে, যা লিভারের ফ্যাট বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
প্রক্রিয়াজাত খাবার
ময়দা দিয়ে তৈরি খাবার, প্যাকেটজাত খাদ্য এবং রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে লিভারে চর্বি জমায়।
দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির উপায়
সকালের নাস্তা
-
চিনি ছাড়া কালো কফি বা গ্রিন টি
-
ওটমিল বা দালিয়ার সাথে বেরি জাতীয় ফল
-
আখরোট বা বাদাম
দুপুরের খাবার
-
হলুদ দিয়ে রান্না করা ডাল
-
ব্রকোলি বা অন্যান্য সবুজ শাকসবজি
-
চর্বিযুক্ত মাছ (সপ্তাহে ২-৩ দিন)
রাতের খাবার
-
বিট বা অন্যান্য রঙিন সবজি
-
রসুন দিয়ে রান্না করা তরকারি
-
হলুদ দুধ (চিনি ছাড়া)
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
খাবারের পাশাপাশি কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তনও প্রয়োজন:
নিয়মিত ব্যায়াম
সপ্তাহে অন্তত ১৫০-২৪০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম করুন। এমনকি ১৩৫ মিনিট ব্যায়ামও লিভারের চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
শরীরের ওজনের ৫-১০% কমালে লিভারের চর্বি ও প্রদাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
পর্যাপ্ত পানি পান
দিনে ২.৫-৩ লিটার পানি পান করুন। এটি লিভারের ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
সতর্কতা ও পরামর্শ
লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না এই তিনটি খাবার গ্রুপ নিয়মিত খেলেও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন:
-
অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলুন
-
ধূমপান বন্ধ করুন
-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
-
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
যদি ইতিমধ্যে ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করুন। মনে রাখবেন, লিভার একটি অদ্ভুত অঙ্গ যা নিজেকে নিরাময় করতে পারে, শুধু সঠিক পুষ্টি ও যত্ন দিলেই।
লিভারে ফ্যাট জমতেই দেবে না এই তিনটি খাবার গ্রুপ – অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পানীয়, হলুদ এবং ফাইবার সমৃদ্ধ সবজি ও ফল – আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং ক্ষতিকর খাবার এড়িয়ে চলার মাধ্যমে আপনি আপনার লিভারকে সুস্থ রাখতে পারেন। মনে রাখবেন, প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা।