ফ্রান্সের রাজনৈতিক সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার মধ্যে গতকাল (১০ সেপ্টেম্বর) সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে “Bloquons Tout” বা “Block Everything” নামক ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন। প্যারিসের রিং রোড থেকে শুরু করে দেশের প্রধান শহরগুলোর সড়কপথে আগুন, ব্যারিকেড এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশে ৮০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করেছে, যার মধ্যে প্যারিসেই রয়েছে ৬ হাজার।
আন্দোলনের প্রথম দিনেই গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ২০০ বিক্ষোভকারী। রেনেস শহরে একটি বাসে আগুন লাগানো হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি পাওয়ার লাইনে ক্ষতিসাধনের ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রেতাইলু প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে “বিদ্রোহের পরিবেশ” সৃষ্টির অভিযোগ এনেছেন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া বেরুর আস্থা ভোটে পরাজয়। বেরুর সরকার ভেঙে পড়ার পর রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গতকাল তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সেবাস্তিয়ান লেকর্নুকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ৩৯ বছর বয়সী লেকর্নু দুই বছরেরও কম সময়ে ম্যাক্রোঁর পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
“Block Everything” আন্দোলনের মূলে রয়েছে সরকারের কর্তিত বাজেট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জনরোষ। বেরুর প্রশাসন ফ্রান্সের ক্রমবর্ধমান ঋণ নিয়ন্ত্রণে ৪৩.৮ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাব করেছিল, যার মধ্যে ছিল দুটি জাতীয় ছুটির দিন বাতিল করা এবং সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাস। এই পরিকল্পনা একযোগে চরমপন্থী বাম ও ডানপন্থী দল এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে।
প্রতিবাদের ধরন এবং ব্যাপকতা ২০১৮ সালের “Yellow Vest” আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই আন্দোলনও জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে শুরু হয়ে পরবর্তীতে ম্যাক্রোঁর অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদে রূপ নেয়। তবে “Block Everything” আন্দোলনের সংগঠন কাঠামো ভিন্ন। এটি কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়া ও এনক্রিপ্টেড চ্যাটের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
মে মাসে ডানপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পরবর্তীতে বামপন্থী ও চরমবামপন্থী দলগুলোর সমর্থন পেয়েছে। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, এই আন্দোলনে দেশব্যাপী প্রায় এক লাখ মানুষের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্যারিসে সকালের যাতায়াতের সময় বিক্ষোভকারীরা বারবার শহরের বেল্টওয়ে অবরোধের চেষ্টা করেছেন। তারা ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশের দিকে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষেপ করেছেন এবং যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করেছেন। পূর্ব প্যারিসের পোর্ট দে মন্ত্রেইয়েলে বিক্ষোভকারীরা আবর্জনার ঝুড়িতে আগুন লাগিয়ে ট্রাম লাইন অবরোধের চেষ্টা করেছেন, যা পুলিশ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
ইউরোপের অন্যতম ব্যস্ততম ট্রেন স্টেশন গার দ্যু নর্ডেও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকশো বিক্ষোভকারী সকাল ১০:৩০ নাগাদ সেখানে সমবেত হলে পুলিশ স্টেশনে প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। তবে বিক্ষোভকারীরা জোর করে প্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
প্যারিসের বাইরেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নঁত শহরে বিক্ষোভকারীরা জ্বলন্ত টায়ার ও আবর্জনার পাত্র দিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে একটি চক্রাকার সড়ক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। মন্পেলিএতে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় যখন তারা যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করার জন্য ব্যারিকেড তৈরি করে। এখানেও পুলিশ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে, কিছু বিক্ষোভকারী প্রত্যুত্তরে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষেপ করেন।
মহাসড়ক পরিচালনাকারী সংস্থা ভিনসি জানিয়েছে যে মার্সেই, মন্পেলিএ, নঁত এবং লিওঁ সহ দেশের বিভিন্ন শহরের মহাসড়কে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। বর্দো শহরে প্রায় ৫০ জন মুখোশধারী ব্যক্তি অবরোধ শুরু করার চেষ্টা করেছেন, আর তুলুজে একটি দ্রুত নিভে যাওয়া আগুন ট্রেন সেবা ব্যাহত করেছে।
আন্দোলনের অভিযোগের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রতি ব্যাপক অসন্তোষ এবং কর্তিত বাজেট পরিকল্পনা। অংশগ্রহণকারীদের দাবিগুলো বিস্তৃত পরিসরে বিস্তৃত, যার মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রোঁর পদত্যাগ থেকে শুরু করে স্থানীয় অভিযোগ পর্যন্ত। অনেক বিক্ষোভকারী যুক্তি দিচ্ছেন যে কর্তিত ব্যবস্থাগুলো অন্যায়ভাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের নাগরিকদের লক্ষ্য করছে যখন ধনী কর্পোরেশনগুলো রেহাই পাচ্ছে।
প্রতিবাদের একজন অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ক্রিস্তফ লালান্দে বলেছেন, “বেরুকে বরখাস্ত করা হয়েছে; তার নীতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর জন্য আরও অর্থায়ন বৃদ্ধি করা দরকার”। আরেকজন ইউনিয়ন প্রতিনিধি আমার লাঘা ঘোষণা করেছেন, “এই দিনটি দেশের সব শ্রমিকদের কাছে একটি বার্তা পাঠায়: কোনো আত্মসমর্পণ হবে না, সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে”।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ শুধু বাজেট কর্তনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অসমতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র টমাস ইউরোনিউজকে বলেছেন, “ম্যাক্রোঁ এবং রাজনীতিবিদদের বোঝার সময় এসেছে যে আমরা গুরুতর। আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ এবং এই বিষয়ে যে অতি-ধনী ও কর্পোরেশনগুলো পর্যাপ্ত কর দিচ্ছে না”।
নতুন প্রধানমন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকর্নুর সামনে এখন অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতি। তিনি একটি বিভক্ত সংসদে ঐক্যমত গড়ে তোলার এবং ২০২৬ সালের জন্য একটি বাজেট পাস করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদ তিনটি ভিন্ন মতাদর্শিক শিবিরে বিভক্ত, এবং কোনো দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।
লেকর্নুর নিয়োগ বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। চরমবাম দল ইতিমধ্যেই তার বিরুদ্ধে দ্রুত অনাস্থা ভোটের হুমকি দিয়েছে। অন্যদিকে, মেরিন লে পেনের জাতীয় সমাবেশ (National Rally) বাজেট বিষয়ে সতর্ক সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়েছে, তবে শর্ত সাপেক্ষে। ডানপন্থী RN সাংসদ লর লাভালেত এক্স-এ লিখেছেন, “বাজেট RN-এর মাধ্যমে হবে নাহলে সরকারের পতন হবে”।
ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর। দেশের জাতীয় ঋণ জিডিপির ১১৪% ছাড়িয়ে গেছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬০% সীমা অতিক্রম করেছে। বাজেট ঘাটতি ২০২৪ সালে জিডিপির ৫.৮% এ পৌঁছেছে, যা ইইউর ৩% সীমার প্রায় দ্বিগুণ। এই পরিস্থিতি ইউরোপীয় কমিশনকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে “অতিরিক্ত ঘাটতি পদ্ধতি” চালু করতে বাধ্য করেছে।
আর্থিক বাজারেও ফ্রান্সের পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ফরাসি সরকারী বন্ড এবং জার্মান বন্ডের মধ্যে সুদের হারের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি গ্রিসের সাথে ফ্রান্সের ঋণের সুদের হার প্রায় সমান হয়ে গেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঝুঁকি সম্পর্কে উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়।
ফরাসি রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অস্থিতিশীলতা বিরল। পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে আধুনিক যুগে বেরুই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি অনাস্থা ভোটের পরিবর্তে আস্থা ভোটে পরাজিত হয়েছেন। ২০২২ সাল থেকে ম্যাক্রোঁর দ্বিতীয় মেয়াদে এটি পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পরিস্থিতিকে ১৯৫৮ সালের পর থেকে ফ্রান্সের সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলাঁ দুহামেল লে মন্ডে পত্রিকায় বলেছেন, “এখন জরুরি প্রশ্ন হলো আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বেঁচে থাকা। ১৯৫৮ সালে দে গলের মধ্যে একটি বিকল্প ছিল। তার সম্পর্কে যা-ই ভাবা হোক না কেন, তার নিঃসন্দেহে একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল”।
“Block Everything” আন্দোলনের সাথে তুলনা করা হচ্ছে ২০১৮ সালের “Yellow Vest” আন্দোলনের। সেই আন্দোলনে ৩০ লাখেরও বেশি ফরাসি নাগরিক অংশ নিয়েছিল, যার ফলে ৬,৪০০ গ্রেফতার, ২,০০০-এর বেশি আহত এবং কমপক্ষে ৫০০টি পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২৩ সালে পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে আরেকটি “বিপ্লব” প্যারিস ও অসংখ্য শহরের রাস্তায় নেমেছিল।
একটি সাম্প্রতিক ইপসস জরিপে দেখা গেছে যে ৪৬% ফরাসি জনগণ “Block Everything” আন্দোলনকে সমর্থন করে, যার মধ্যে বামপন্থী ভোটারদের পাশাপাশি অর্ধেকেরও বেশি চরমডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালির ভোটাররাও রয়েছে। আরেকটি জরিপে ৬৩% মানুষ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, ২৬% বিরোধিতা করেছে এবং ১১% নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মেসি কর্মীরা চিকিৎসা প্রতিদানে কর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ইউনিয়নগুলো সতর্ক করেছে যে ফ্রান্সের ২০,০০০ ফার্মেসির মধ্যে ৬,০০০টি বন্ধ হতে পারে। বেরুর ভেঙে পড়া সরকার ফ্রান্সের সরকারি ঘাটতি কমানোর জন্য দুটি ব্যাংক হলিডে কেটে ফেলার প্রস্তাব করেছিল, যার মধ্যে একটি ব্যাপক ক্রোধের জন্ম দিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই অস্থিতিশীলতা ইউরোপের জন্য উদ্বেগের বিষয়। ইউক্রেইন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের মুখে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই পরিস্থিতি ইউরোজোনের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাশ উল্লেখ করেছে যে নীতিগত অনিশ্চয়তা ২০২৫ সালে ফ্রান্সের প্রবৃদ্ধি ০.৬%-এ সীমিত রাখতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের দিক থেকে, এই সংকট ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। তার অনুমোদনের হার ১৫% পর্যন্ত নেমে গেছে, এবং কিছু কণ্ঠস্বর তাকে ২০২৭ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ম্যাক্রোঁ দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তার সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি স্থিতিশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই শাসন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
আগামী সপ্তাহগুলো ফ্রান্সের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। আন্দোলনকারীরা ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করেছেন, যেদিন আন্তর-ইউনিয়ন জাতীয় প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছে। যদি লেকর্নু সফলভাবে বাজেট পাস করতে এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো তার দ্বিতীয় মেয়াদ রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ব্যর্থ হলে ফ্রান্স দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অচলাবস্থায় পড়তে পারে।