নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা: কেন পরিবর্তন করল সরকার?

সরকার সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’—এই দুই শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ করেছে। এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বীকৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে এবং…

Chanchal Sen

 

সরকার সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’—এই দুই শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ করেছে। এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বীকৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে এবং এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

গত ৪ জুন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) যারা এতদিন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন, এখন থেকে তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের জন্য পাঁচটি শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়েছে—যেমন বিদেশে অবস্থানকারী পেশাজীবী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও সাংবাদিক, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলসহ আরও অনেকে।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেবলমাত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে বা ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে, সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, এমন ব্যক্তিরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, মুজিবনগর সরকার ও স্বীকৃত বাহিনীর সদস্য, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্য, এবং নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা) ও ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরাও এই স্বীকৃতি পাবেন।

অন্যদিকে, যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি, বরং সংগঠক, বিদেশে জনমত গঠনকারী, চিকিৎসা সহায়তাকারী, সাংবাদিক, শিল্পী বা ফুটবল দলের সদস্য হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে গণ্য হবেন। এর ফলে অনেকেই, বিশেষ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা, আগের মতো আর ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ নন, বরং সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।

এই পরিবর্তনের পেছনে সরকারের বক্তব্য হলো, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত ও বিতর্ক নিরসনের জন্য সংজ্ঞা স্পষ্ট করা জরুরি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেছেন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কেবলমাত্র যারা সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাদেরই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। অন্যরা সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, তবে আলাদা শ্রেণিতে—এমন দাবির ভিত্তিতেই এই পরিবর্তন।

এছাড়া, ১৯৭২ সালের সংজ্ঞা পুনরায় কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। ২০১৮ ও ২০২২ সালে সংজ্ঞা পরিবর্তনের সময় মুক্তিযোদ্ধার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ফুটবল দলের সদস্যসহ যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। এবার সেই সংজ্ঞা সংকুচিত করে মূলত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে রাখা হয়েছে।

নতুন সংজ্ঞায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। যেমন, মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১২ বছর ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১৩ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং বয়স নির্ধারণের ভিত্তি ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বরের বদলে ২৬ মার্চ করা হয়েছে। এছাড়া, আইনের প্রস্তাবনা থেকে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী—দুই শ্রেণির সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা সমান থাকবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা সমান থাকবে, শুধু শ্রেণিভেদ থাকবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতির ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হবে এবং অনেকের জন্য এটি সম্মানহানিকর হতে পারে।

সংজ্ঞা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্বচ্ছতা ও সঠিকতা আনাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

সবশেষে বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন দেশের ইতিহাস ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এটি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও স্মৃতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, একই সঙ্গে নতুন বিতর্কও তৈরি করেছে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, সংজ্ঞা পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিতকরণ, বিতর্ক নিরসন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত যোদ্ধাদের যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া। তবে, এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছেই—এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।