Iran Israel conflict: ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও, এই দুই দেশের সম্পর্ক একসময় ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। তবে ১৯৭৯ সালের ইরানি ইসলামি বিপ্লবের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। বর্তমানে এই দ্বন্দ্ব শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা ও রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শত্রুতা প্রকাশ্য সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে, যার সর্বশেষ নজির ২০২৪ ও ২০২৫ সালের সরাসরি হামলা-পাল্টা হামলা।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর, ইরান ছিল তুরস্কের পরে দ্বিতীয় মুসলিম দেশ যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। সেই সময় ইরানে শাসন করছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। তার আমলে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইরান তখন নিয়মিতভাবে ইসরায়েলকে তেল সরবরাহ করত এবং দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
তবে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি ধর্মভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সরকার ইসরায়েলকে “ছোট শয়তান” হিসেবে আখ্যা দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণা করে। তেহরানে ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে সেটিকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
ইরান-ইসরায়েল বৈরিতার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ফিলিস্তিন প্রশ্ন: ইরান ফিলিস্তিনিদের সমর্থন এবং ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, যেখানে ইসরায়েল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়।
- আঞ্চলিক আধিপত্য: মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
- পরমাণু কর্মসূচি: ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে এবং তা প্রতিহত করতে নানা কৌশল গ্রহণ করেছে।
- প্রক্সি যুদ্ধ: ইরান সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে না গিয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, ইয়েমেনি হুতি, সিরিয়ান মিলিশিয়াসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। অপরদিকে, ইসরায়েল এই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সিরিয়া ও লেবাননে নিয়মিত বিমান হামলা চালায় এবং ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে গুপ্তহত্যা চালানোর অভিযোগও রয়েছে।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে এই দ্বন্দ্ব প্রক্সি যুদ্ধ ও গুপ্তচরবৃত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ, সিরিয়া গৃহযুদ্ধ, ইয়েমেন সংকট এবং গাজা যুদ্ধের মতো ঘটনাগুলোতে ইরান ও ইসরায়েল পরোক্ষভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শত্রুতা আরও প্রকাশ্য ও সরাসরি রূপ নিয়েছে। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের দুই জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার নিহত হন। এর জবাবে ১৩ এপ্রিল ইরান, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যান্য মিত্রদের সহযোগিতায় ইসরায়েলের ওপর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়—যা ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য ও সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে সহায়তা করে এবং অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত হয়।
২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল আবারও ইরানের রাজধানী তেহরানে বড় ধরনের হামলা চালায়, যেখানে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয় এবং একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানী নিহত হন। ইসরায়েল এই হামলার যৌক্তিকতা হিসেবে ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচিকে উল্লেখ করে, যা তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি বলে মনে করে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই দ্বন্দ্বের গভীরে রয়েছে আঞ্চলিক আধিপত্য, ধর্মীয় মতাদর্শ, নিরাপত্তা শঙ্কা ও ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। ইরান ইসলামী বিপ্লবের পর নিজেদেরকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে সামনে রেখে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়। অপরদিকে, ইসরায়েল চায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে এবং ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমন করতে।
উল্লেখ্য, এই দ্বন্দ্ব শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় দেশ, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তিও জড়িত। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের কারণে গোটা অঞ্চলজুড়ে অস্থিতিশীলতা, মানবিক সংকট এবং নিরাপত্তা হুমকি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা বৃহত্তর যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের শুরু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই। তবে এই শত্রুতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধ, সাইবার হামলা, গুপ্তহত্যা থেকে সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। পারমাণবিক কর্মসূচি, আঞ্চলিক আধিপত্য ও ধর্মীয় মতাদর্শ এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক করে তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, বরং নতুন নতুন সংঘাত ও উত্তেজনার আশঙ্কাই বেশি।