কলকাতার হেরিটেজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বায়োটেকনোলজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র অর্ণব পাল সর্বভারতীয় স্তরে ২০২৫ সালের গ্র্যাজুয়েট অ্যাপটিটিউট টেস্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (গেট) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। বিশেষত্ব হল, অর্ণব শুধু একজন মেধাবী ছাত্রই নন, তিনি একজন জাতীয় স্তরের ক্রীড়াবিদও, যিনি গ্র্যাপলিং-এ তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
অর্ণবের এই সাফল্য বাংলার নাম আবারও সারা ভারতে উজ্জ্বল করেছে। ৬৬.৬৭ নম্বর পেয়ে তিনি বায়োটেকনোলজি বিষয়ে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য এই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অত্যন্ত গর্বিত।
সাফল্যের পিছনে রয়েছে একটি বিশেষ গল্প। অর্ণবের ক্রীড়া জীবনে অনেক উচ্চতা ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর তাঁর খেলাধুলার জীবনে বিরতি আসে। এরপর তিনি পড়াশোনার দিকে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। মাত্র আড়াই মাসের কঠোর প্রস্তুতির পর তিনি এই চমকপ্রদ ফলাফল করতে সক্ষম হয়েছেন।
নিজের সাফল্য সম্পর্কে অর্ণব জানিয়েছেন, “গেট হলো মাস্টার্সের প্রবেশদ্বার। আমি সবসময় একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছি। আইআইটি থেকে মাস্টার্স করাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প, তাই আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অবাক করার মতো বিষয় হল, আমি আসলে পরীক্ষার ফলাফলে তেমন সন্তুষ্ট ছিলাম না, কারণ মক টেস্টে আমার নম্বর এর থেকে ভালো ছিল। এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি জাতীয়ভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেছি।”
অর্ণবের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল কলকাতার নব নালন্দা স্কুলে, যেখানে তিনি পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি প্রতি ক্লাসেই প্রথম হতেন। তবে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিনের জন্য পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন।
মজার বিষয় হল, অর্ণবের একজন যমজ ভাই রয়েছেন, যিনি এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন পড়ছেন। অর্ণব স্বীকার করেছেন যে তাঁর ভাইয়ের কারণেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। পারিবারিক পরিবেশও তাঁর সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর বাবা সঞ্জয় পাল, যিনি একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তাঁকে শুধু বিষয়বস্তু নয়, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূলনীতিগুলিও শিখিয়েছেন।
পড়াশোনার পাশাপাশি অর্ণব ক্রীড়া জগতেও সমান পারদর্শী। গ্র্যাপলিং-এ তিনি তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। নিজের প্রস্তুতি পদ্ধতি সম্পর্কে অর্ণব বলেন, “আমি প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা পড়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, তবে বাস্তবে ৫-৬ ঘন্টা পড়তে পারতাম। আমি টিপিক্যাল বইপোকা নই। আমি অ্যানিমে দেখতে এবং মাঙ্গা পড়তে পছন্দ করি।” তিনি বায়োপ্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য সংখ্যাত্মক সমস্যা সমাধানের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, মক টেস্ট এবং রিভিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অর্ণব তাঁর বন্ধুদের কাছেও কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, “আমরা মক টেস্টের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করতাম এবং একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করতাম। বন্ধুদের সমর্থন সবচেয়ে বেশি পার্থক্য তৈরি করেছে।” তাঁর ক্রীড়া প্রশিক্ষণও চাপের মধ্যে সংযত থাকতে সাহায্য করেছে, যা গেট পরীক্ষায় তাঁর সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
হেরিটেজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যক্ষ বাসব চৌধুরী অর্ণবের সাফল্যে খুশি। তিনি বলেন, “অর্ণবের এই ফলাফল আমাদের প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করবে।”
এবছর গেট পরীক্ষা ২০২৫ আইআইটি রুরকি দ্বারা আয়োজিত হয়েছিল। পরীক্ষাটি ফেব্রুয়ারি ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত কম্পিউটার ভিত্তিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় নয় লক্ষ পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ১৯ মার্চ ২০২৫ তারিখে। গেট স্কোর তিন বছর পর্যন্ত বৈধ থাকে এবং এম.টেক ভর্তি, পিএসইউ চাকরি, ফেলোশিপ এবং গবেষণা কর্মসূচির জন্য ব্যবহার করা যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অর্ণব বলেছেন যে তিনি আইআইটি মাদ্রাজে বায়োপ্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স করতে চান। তাঁর লক্ষ্য বায়োটেকনোলজির শিক্ষাগত এবং শিল্প ক্ষেত্রে উভয়তেই নিজের ছাপ রেখে যাওয়া। তিনি বলেন, “আমি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করি। তা রিং বা গবেষণাগারই হোক, আমি আমার সীমানা ঠেলে এগিয়ে যেতে চাই।”
অর্ণবের এই সাফল্য দৃঢ়তা এবং সংকল্পের প্রমাণ। কুস্তির ম্যাটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে শুরু করে কঠিনতম ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশ্নের সমাধান করা পর্যন্ত, তিনি প্রমাণ করেছেন যে কোনো বাধাই স্থায়ী নয়। তিনি তার যাত্রা, প্রতিটি পতন, প্রতিটি লড়াই এবং প্রতিটি বিজয়ের জন্য কৃতজ্ঞ। নিঃসন্দেহে, অর্ণব পাল নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবেন।