পুজো থেকে আধ্যাত্মিকতা: প্রত্যেক পূজার আগে ঘট প্রতিষ্ঠার গূঢ় রহস্য

Ghat Sthapana meaning and significance: সনাতন ধর্মের প্রতিটি পূজা-পার্বণে একটি অপরিহার্য উপাদান হল ঘট। দেবী হোক বা দেবতা, প্রতিমা হোক বা ছবি - কোনো পূজাই ঘট ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না।…

Avatar

 

Ghat Sthapana meaning and significance: সনাতন ধর্মের প্রতিটি পূজা-পার্বণে একটি অপরিহার্য উপাদান হল ঘট। দেবী হোক বা দেবতা, প্রতিমা হোক বা ছবি – কোনো পূজাই ঘট ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। পূজার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় ঘট স্থাপন, কিন্তু কেন এই প্রথা এতটাই অপরিহার্য? কেন পুরোহিতরা সবার আগে ঘট প্রতিষ্ঠা করেন? আসুন জেনে নিই এই প্রাচীন প্রথার আসল রহস্য ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য।

ঘট: নিরাকার ব্রহ্মের সাকার প্রতীক

ঘট কেবল একটি সাধারণ পাত্র নয়, এটি ভগবানের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। সনাতন ধর্মে প্রত্যেক দেবদেবী এক অভিন্ন নিরাকার পরম ব্রহ্মেরই এক একটি সাকার রূপের প্রকাশ। যখন আমরা কোনো দেবতার সাকার রূপের পূজা করি, তখন সেই দেবতার নিরাকার রূপকেও পূজা করা জরুরি। ঘট সেই নিরাকার দিব্য শক্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করে। তাই ঘট স্থাপন ছাড়া পূজা করলে সেই পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়।

আধ্যাত্মিক ভাষায় আমাদের দেহকে ‘দেহঘট’ বলা হয়। ঘটকে আমাদের দেহের প্রতীক হিসেবে মানা হয়, এই কারণেই প্রত্যেক পূজোর আগে ঘট স্থাপন করা আবশ্যিক। প্রতিটি পূজায় ঘটের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহকে দৈবী শক্তির ধারক হিসেবে উৎসর্গ করি।

Surya Pranam: সূর্যের সাথে সকালের সম্পর্ক, আপনার জীবন বদলে দেওয়ার ৭টি কারণ

পঞ্চমহাভূত থেকে মানবদেহ: ঘট প্রতিষ্ঠার আধ্যাত্মিক অর্থ

ঘট স্থাপনের প্রত্যেকটি ধাপের পিছনে গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে। ঘট প্রতিষ্ঠার সময় পঞ্চ তত্ত্ব থেকে শুরু করে মানবদেহের প্রতিটি অংশকে প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

পঞ্চমহাভূতের প্রতিনিধিত্ব

ঘটের বিভিন্ন অংশ পঞ্চমহাভূতকে প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন:

  • ঘটের চওড়া অংশ পৃথিবীকে (ক্ষিতি) নির্দেশ করে

  • প্রসারিত কেন্দ্র জলকে (অপ) নির্দেশ করে

  • ঘটের ঘাড় অগ্নিকে (তেজ) নির্দেশ করে

  • মুখের খোলা অংশ বায়ুকে (মরুৎ) নির্দেশ করে

  • ঘটের মুখের ডাব ও আমের পল্লব আকাশকে (ব্যোম) নির্দেশ করে

ঘট প্রতিষ্ঠার বিধি ও উপকরণ

ঘট স্থাপনের জন্য বিশেষ উপকরণ ও বিধি রয়েছে। প্রতিটি উপকরণের পিছনে একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে:

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

  • পঞ্চগুড়ি

  • পঞ্চশস্য

  • পঞ্চপল্লব

  • পঞ্চরত্ন

  • জল বা গঙ্গাজল

  • মৃত্তিকা বা মাটি

  • নারিকেল বা ডাব

  • গামছা অথবা বস্ত্র

ঘট প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি সুনির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়।

পঞ্চগুড়ি ও পীঠ স্থাপন

প্রথমেই পঞ্চগুড়ি দিয়ে পীঠ তৈরি করা হয়। এই পঞ্চগুড়ি হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম তথা পঞ্চমহাভূতের প্রতীক। এই পঞ্চমহাভূতের উপর মৃত্তিকা দিয়ে পিঠ বা বেদী নির্মাণ করা হয়। আদর্শতঃ গঙ্গার মাটি ব্যবহার করা উত্তম, তবে তা সম্ভব না হলে কোন পবিত্র পুষ্করিণী বা নদীর মাটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

পঞ্চশস্য ও পঞ্চবৃত্তি

মৃত্তিকাপীঠের উপরে পঞ্চশস্য দেওয়া হয়। এটি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্য এই পঞ্চবৃত্তির প্রতীক। এই ভাবে আমরা আমাদের মানসিক দোষগুলিকে স্বীকার করে পবিত্রতার পথে অগ্রসর হওয়ার সংকল্প করি।

পঞ্চরত্ন স্থাপন

এরপর ঘটের ভিতরে পঞ্চরত্ন দেওয়া হয়। এই পঞ্চরত্ন চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা, অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয়ের প্রতীক। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে দৈবী শক্তির কাছে সমর্পণ করি।

জল পূরণ ও পঞ্চপল্লব স্থাপন

এরপর ঘটে জল ভরা হয়। এর অর্থ হল দেহকে দেহরস বা রক্ত দিয়ে পূর্ণ করা। গঙ্গাজল ব্যবহার করা উত্তম, না হলে যে কোনো পবিত্র জল ব্যবহার করা যেতে পারে। তারপর ঘটের উপর যে পঞ্চপল্লব দেওয়া হয় তা হল গলা বা গ্রীবার প্রতীক।

নারিকেল স্থাপন

ঘটের উপর নারকেল বা ডাব স্থাপন করা হয়। নারকেলে আমাদের মুখের মতো চোখ, নাক, মুখ দেখা যায়, যা আমাদের মুখমণ্ডলের প্রতীক। এটি ঘটের সবচেয়ে উপরের অংশ যা মানব মস্তিষ্ককে প্রতিনিধিত্ব করে। নারকেলের উপর অনেক সময় বস্ত্র বা গামছা দিয়ে আচ্ছাদন দেওয়া হয়।

এভাবে ঘট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের প্রতিরূপ তৈরি হয়।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘট প্রতিষ্ঠার বৈচিত্র্য

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘট প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিতে কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়। বিভিন্ন দেবতার জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘট ব্যবহার করা হয়।

গণেশঘট: গণেশঘটের বিশেষত্ব হল, এই ঘটের উপর মাটির শুঁড় বিদ্যমান থাকে।

মনসাঘট: পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার মনসাঘটগুলিতে একটি নাগচিহ্ন বা অষ্টনাগ ঘটটিকে বেষ্টন করে রাখে। বরিশালের শিল্পীদের তৈরি ঘটের মধ্যভাগে একটি স্ফীত অংশ তৈরি করা হয়; সেই স্ফীত অংশের উপরেই আঁকা হয় মনসার পট।

লক্ষ্মী ঘট: বাংলার লক্ষ্মীপূজায় ঘটের উপরে পান, সুপারি ও কলা দেওয়ার রীতি রয়েছে। পান যোনির প্রতীক, কলা লিঙ্গের প্রতীক, আমশাখা নাড়ির প্রতীক, ঘটজল দেহরস বা রক্তের প্রতীক এবং ঘটের স্ফীত অংশ গর্ভের চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় লোকজ চর্চায়।

দুর্গাঘট: কলকাতার বিভিন্ন পরিবারের দুর্গাঘটের গ্রীবাদেশ গ্রামের ঘটের গ্রীবাদেশের তুলনায় সরু হয়।

শনিঘট: বাংলার বহুল প্রচলিত শনিপূজায় গ্রামাঞ্চলে কালো রঙের মাটির ঘট বা লোহার ঘটের ব্যবহার দেখা যায়।

এছাড়া ফরিদপুরের বাঙালদের মধ্যে দুর্গাপূজার দশমীর দিন, আগের বছর পুজো হওয়া লক্ষ্মীসরার উপরে মাটির ক্ষেত্র তৈরি করে ধানবীজ রোপণ করার প্রথা রয়েছে। কার্তিক পুজোর দিন সেই ক্ষেত্রে পাঁচটি আতপচাল ভর্তি ঘট পাতা হয় এবং ঘটের উপরে জলপাই রাখা হয়।

ঘট প্রতিষ্ঠার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

ঘট প্রতিষ্ঠার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম। ঘট স্থাপনের মাধ্যমে আমরা পঞ্চমহাভূত ও মানবদেহের সংযোগ স্থাপন করি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহকে দৈবী উপস্থিতির জন্য পাত্র হিসেবে প্রস্তুত করি।

আবাহন অপ্রয়োজনীয়তা: ঘট প্রতিষ্ঠিত থাকলে আবাহন অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। কারণ, ঘট দেবতার উপস্থিতির স্থায়ী আধার হিসেবে কাজ করে। এটি পূজার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে।

পূর্ণাঙ্গ পূজার অপরিহার্য অংশ: বিধিমতে পূজা সুসম্পন্ন করতে হলে ঘটের ব্যবহার অপরিহার্য। দেবতার ছবি হোক বা মূর্তি, ঘট ছাড়া পূজা সম্পূর্ণ হয় না। ঘট স্থাপন পূজার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

বিশ্বের ৭টি সর্বাধিক পবিত্র গাছ: যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির মিলন ঘটেছে

ঘট প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

ঘট শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপনয়ন, ব্রত থেকে বিবাহ, অন্নপ্রাশন—বাঙালির মঙ্গলাচারে গুরুত্বপূর্ণতম অঙ্গ এই ঘট।

ঘটের ব্যবহার শুধু দেব-দেবীর পূজায় নয়, বিশেষ বিশেষ ঋতু পরিবর্তনের সময়ও দেখা যায়। যেমন, ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, ২৪ পরগনা ইত্যাদি জেলায় ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পুজোর রীতি প্রচলিত। লোক-গবেষকদের মতে, ঘেঁটুপুজোর উদ্ভবের কারণ, ঋতু পরিবর্তনের সময়কার চর্মরোগের হাত থেকে মুক্তি প্রার্থনা।

পূজার বিশেষ নিয়ম ও ঘটের ভূমিকা

পূজার কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে যেখানে ঘটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য:

  • পূজার আগে সর্বদা ভূতশুদ্ধি করে নিতে হয়

  • ঘট, পট, যন্ত্র, প্রতিমা, শালগ্রাম না থাকলে জলের ওপর দেব-দেবীর পূজা করা যায়

  • ঘট প্রতিষ্ঠিত থাকলে আবাহন অপ্রয়োজনীয়

দেবতা অনুসারে ঘটের উপকরণেও পরিবর্তন হতে পারে। যেমন:

  • দেবীর পূজায় তুলসীপত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ

  • গণেশ পূজায় তুলসী এবং সূর্যদেবের পূজায় ধুতুরা ফুল, বিল্বপত্র ব্যবহার করা যায় না

  • নারায়ণ পূজায় রক্তপুষ্প ব্যবহার নিষিদ্ধ

  • শিব ও সূর্যের অর্ঘ্যে শঙ্খ দেওয়া নিষিদ্ধ

প্রত্যেক পূজার আগে ঘট প্রতিষ্ঠার প্রথা সনাতন ধর্মের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক প্রথা নয়, বরং এর মাধ্যমে মানব দেহ, প্রকৃতি এবং দৈবী শক্তির মধ্যে একটি গভীর সংযোগ স্থাপিত হয়। ঘট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহকে দৈবী উপস্থিতির আধার হিসেবে প্রস্তুত করি এবং পঞ্চমহাভূতের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করি।

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে অনেক প্রাচীন রীতি-নীতি হারিয়ে গেলেও, ঘট প্রতিষ্ঠার এই প্রথা আজও অটুট রয়েছে। এর কারণ হল, এই প্রথার পিছনে রয়েছে গভীর দার্শনিক ভিত্তি। এই প্রাচীন ঐতিহ্য আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে এবং আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।প্রত্যেক পূজার আগে ঘট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা নিরাকার ব্রহ্মের উপস্থিতিকে স্বীকার করি এবং আমাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে অর্থপূর্ণ করি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেবতা শুধু মূর্তি বা প্রতিমাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি সর্বব্যাপী এবং সর্বত্র বিরাজমান।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম