ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কারণে গাজা উপত্যকার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। হাতে নগদ অর্থের অভাবে স্থানীয় বাসিন্দারা এখন আদিকালের বিনিময় প্রথায় ফিরে গেছে, যেখানে একটি পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্য নেওয়া হচ্ছে। একইসাথে চরম খাদ্য সংকটের কারণে অনাহারে মৃতের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে, যা এখন পর্যন্ত ১৬৯ জনে পৌঁছেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এখন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে দালালের সাহায্য নিতে হয়, যারা প্রায় অর্ধেক অর্থ কমিশন হিসেবে রেখে দেয়। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নগদ অর্থের পরিবর্তে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। দুই বছর ধরে ছেঁড়া-ফাটা নোট দিয়েই চলছে দৈনন্দিন কেনাকাটা, কারণ নতুন নোটের ব্যবস্থা নেই।
খাদ্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে গাজায়। বর্তমানে দুই কেজি ডাল এবং এক কেজি আটার দাম ২৫ হাজার টাকার বেশি। এক ক্যান শিশুর দুধের দাম ১০০ ডলার বা প্রায় ১২ হাজার টাকা। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে নিয়মিত খাবার কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
গাজায় যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শিশুদের করুণ পরিণতি: এক গভীর পর্যালোচনা
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গাজায় অনাহার ও অপুষ্টিজনিত কারণে মৃতের সংখ্যা ১৬৯ জনে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ৯৩ জনই শিশু। শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে অনাহারে। গত মাসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষ ১১ দিনে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা এর আগের ২১ মাসের মোট মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করে জানিয়েছে যে গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কয়েকদিন ধরে অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। গাজার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অনাহারে রয়েছে এবং দশজনের মধ্যে নয়জনেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন খাবার পাচ্ছে না। ৪৮ শতাংশ লোক চরম ক্ষুধায় ভুগছে।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেছেন, “ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মৃত্যু ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে”। আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র খলিল আল-দাকরান জানিয়েছেন যে বন্দুকের গুলিতে আহতদের সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, ক্ষুধার্ত রোগীদের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে প্রায় ৬ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন, যার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছেন। অপুষ্টির লক্ষণ হিসেবে পানিশূন্যতা ও রক্তাল্পতা দেখা যাচ্ছে। এমনকি ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীরাও ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন।
মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে যখন শিশুদের মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করেছে। মাত্র ছয় সপ্তাহ বয়সী ইউসুফ আল-সাফাদির মৃত্যু হয়েছে উত্তর গাজা সিটির একটি হাসপাতালে। তার চাচা আদহাম আল-সাফাদি জানিয়েছেন যে শিশুটির মা দুধ উৎপাদন করতে পারছিলেন না কারণ তিনিও খেতে পারছিলেন না। আরেক শিশু, ১৩ বছর বয়সী আব্দুল হামিদ আল-ঘালবান মারা গেছে দক্ষিণের খান ইউনিসে।
অর্থনৈতিক সংকট এত গভীর যে ব্যাংকিং ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। যারা জমানো টাকা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন, তাদেরও ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দালালের মাধ্যমে টাকা তুলতে গেলে প্রায় অর্ধেক টাকা কমিশন দিতে হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ গাজা যুদ্ধের অবিলম্বে অবসান দাবি করেছে। তারা বলেছে যে গাজায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নতুন করে ভয়াবহ এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের ত্রাণ সরবরাহ পদ্ধতিকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দিতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা মানুষকে সাহায্য করতে চাই। আমরা চাই তারা বেঁচে থাকুক। আমরা চাই তারা খেতে পারুক।” তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবে কীভাবে রূপ নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
পটভূমিতে রয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কারণে গাজার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। লাগাতার বোমাবর্ষণে হাসপাতাল, স্কুল, বাজার সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজার প্রায় ৮৮ শতাংশ এলাকা এখন সামরিকীকরণ অথবা বাস্তুচ্যুতির আওতায় পড়েছে।
খাদ্য সংকটের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা এখন বিভিন্ন উপায়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে খাবার কিনছেন। কেউ কেউ পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করছেন। এমনকি গহনা, কাপড়চোপড় ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র দিয়ে খাবার কেনার ঘটনাও ঘটছে।
ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে এমনকি স্বাস্থ্যকর্মী ও ত্রাণকর্মীরাও ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি গাজার মানবিক বিপর্যয়ের গভীরতা তুলে ধরে।
জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে “একটি ভয়াবহ প্রদর্শনী” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যেখানে মৃত্যু, ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। অবরোধ, নিরাপত্তা সংকট ও অনুমতির জটিলতায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত রয়ে গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি গাজাবাসীর জন্য এক অমানবিক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ইসরায়েলি হামলার আতঙ্ক, অন্যদিকে চরম খাদ্য ও নগদ অর্থের সংকট – এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গাজার মানুষ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। যতক্ষণ না এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান হয়, ততক্ষণ গাজার মানুষকে এই অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যেই বেঁচে থাকতে হবে।