Soumya Chatterjee
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২:০০ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: জীবনের কোড পরিবর্তনের অসাধারণ প্রযুক্তি

CRISPR Technology: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হল একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যা জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় একটি জীবের ডিএনএ থেকে নির্দিষ্ট জিন বের করে অন্য জীবে প্রবেশ করানো হয়, যার ফলে সেই জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এটি জীববিজ্ঞান, জৈবপ্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবাত্মক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সংজ্ঞা ও ইতিহাস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, যাকে জেনেটিক মডিফিকেশন বা জেনেটিক ম্যানিপুলেশনও বলা হয়, হল একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি জীবের জিনোম পরিবর্তন করা হয়। এই পদ্ধতিতে একটি জীবের ডিএনএ থেকে নির্দিষ্ট জিন বের করে অন্য জীবের ডিএনএ-তে প্রবেশ করানো হয়, যার ফলে সেই জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ইঁদুরের মধ্যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ১৯৮২ সালে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে ইনসুলিন তৈরি করতে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে খাদ্য উৎপাদনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়।

সেনাবাহিনীর MES নিয়োগ ২০২৪: ৪১,৮২২টি গ্রুপ C পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত, আবেদনের তারিখ শীঘ্রই

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রকারভেদ

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  1. রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তি
  2. CRISPR-Cas9
  3. জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়াস (ZFNs)
  4. ট্রান্সক্রিপশন অ্যাক্টিভেটর-লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়াস (TALENs)
  5. জিন থেরাপি
  6. সিন্থেটিক বায়োলজি

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কার্যপদ্ধতি

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কার্যপদ্ধতি বেশ জটিল। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে একটি জীব থেকে কাঙ্ক্ষিত জিন বের করা হয়। এরপর সেই জিনটি অন্য একটি জীবের ডিএনএ-তে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে নতুন জীবের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা হয়।উদাহরণস্বরূপ, একটি উচ্চফলনশীল কিন্তু কম মিষ্টি আমের জাতের সাথে একটি কমফলনশীল কিন্তু অত্যন্ত মিষ্টি আমের জাতের জিন মিশ্রণ করে একটি নতুন জাতের আম তৈরি করা যেতে পারে যা উচ্চফলনশীল এবং অত্যন্ত মিষ্টি হবে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার ব্যাপক। এর প্রধান ব্যবহারগুলো হল:

কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার

কৃষিক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে উচ্চফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং পরিবেশ সহনশীল ফসল উৎপাদন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ:

  • উচ্চ শীব্র (BRRI) জাতের বহু ভ্যারাইটির ধানের বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে
  • বেগুনি কালারের উফশী ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে
  • সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তৈলবীজ, টমেটো, পেঁপে ইত্যাদির জিন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে
  • পোকা-মাকড়, ছত্রাক ও ভাইরাস প্রতিরোধী ফসল তৈরি করা হয়েছে
  • খরা ও ঠান্ডা সহনশীল ফসল উৎপাদন করা হয়েছে

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার

চিকিৎসা ক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এবং ওষুধ উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • ইনসুলিন উৎপাদন: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইনসুলিন উৎপাদন করা হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে। E. coli ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে মানুষের ইনসুলিন উৎপাদনকারী জিন প্রবেশ করিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করা হয়।
  • জিন থেরাপি: জিন থেরাপির মাধ্যমে বিভিন্ন জেনেটিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। এই পদ্ধতিতে ত্রুটিপূর্ণ জিন পরিবর্তন করে রোগীকে সুস্থ করা হয়।
  • ভ্যাকসিন উৎপাদন: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য তামাক গাছে জেনেটিক পরিবর্তন করা হয়েছে।

শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার

শিল্প ক্ষেত্রেও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার ব্যাপক। এর মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • এনজাইম উৎপাদন: বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত এনজাইম উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।
  • জৈব জ্বালানি উৎপাদন: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জৈব জ্বালানি উৎপাদন করা হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুবিধা

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনেক সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  1. উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদন: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদন করা যায়, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
  2. রোগ প্রতিরোধী ফসল: এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী ফসল উৎপাদন করা যায়, যা কৃষকদের ক্ষতি কমায়।
  3. পরিবেশ সহনশীল ফসল: খরা, লবণাক্ততা, ঠান্ডা ইত্যাদি প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন ফসল উৎপাদন করা যায়।
  4. ওষুধ উৎপাদন: বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধ উৎপাদন করা যায় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে।
  5. জেনেটিক রোগের চিকিৎসা: জিন থেরাপির মাধ্যমে বিভিন্ন জেনেটিক রোগের চিকিৎসা করা যায়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অসুবিধা

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এগুলো হল:

  1. জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফলে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ জেনেটিক মডিফিকেশন করা ফসলগুলি প্রাকৃতিক জাতের সাথে প্রতিযোগিতা করে এবং তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
  1. স্বাস্থ্য ঝুঁকি: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার খাওয়ার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও এই বিষয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে, তবে অনেকেই এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে চান।
  2. নৈতিক ও আইনগত সমস্যা: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে নৈতিক বিতর্ক রয়েছে। যেমন, কিছু মানুষ মনে করেন যে এটি “প্রাকৃতিক” জীবনের সাথে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর ফলে অপ্রত্যাশিত পরিণতি হতে পারে। এছাড়া, প্রযুক্তির মালিকানা ও প্যাটেন্টিং সম্পর্কিত আইনগত সমস্যা রয়েছে।
  3. সামাজিক অসমতা: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি কেবলমাত্র কিছু দেশের জন্য উপলব্ধ, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা সৃষ্টি করতে পারে। উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়ে পড়তে পারে।

চাষের মাঠে রোবট! কৃষিতে AI-এর যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটাচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলি

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভবিষ্যৎ

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন যা আরও কার্যকরী এবং নিরাপদ। CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে জিন সম্পাদনার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও দ্রুত হয়েছে।এছাড়া, জিন থেরাপি এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যক্তিগতকৃত জিন থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা রোগীর বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি বিপ্লবাত্মক প্রযুক্তি যা আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিককে পরিবর্তন করতে সক্ষম। কৃষি, চিকিৎসা এবং শিল্প ক্ষেত্রে এর ব্যবহার আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজতর করেছে এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তবে, এর কিছু অসুবিধা ও ঝুঁকি রয়েছে যা আমাদের সচেতন হতে হবে। সঠিক নীতিমালা ও গবেষণার মাধ্যমে আমরা এই প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করতে পারি এবং মানবজাতির উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর এই বিশাল সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এটি নিশ্চিত করবে যে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close