পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে বর্ষা মানেই বন্যার আতঙ্ক। ১৯৮২ সালে যে মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাস হয়েছিল, সেই ফলকটিও আজ ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু পরিকল্পনা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। চলতি বছর প্রবল বৃষ্টিতে ঘাটাল হয়ে উঠেছে ‘ইতালির ভেনিস’, আর ঘাটালবাসী এখনও অপেক্ষায় রয়েছে কবে তাদের এই জল-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে1।
ঘাটালের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গঠনই এই সমস্যার মূল কারণ। শিলাবতী, কংসাবতী এবং দ্বারকেশ্বর নদের শাখা নদী ঝুমির সঙ্গমস্থল হিসেবে পরিচিত এই এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধানে ১৯৫২ সালে লোকসভায় প্রথম নদী সংস্কারের কথা তুলে ধরেন ঘাটালের তৎকালীন বাম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে ১৯৫৯ সালে নদী বিশেষজ্ঞ মান সিংয়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়, যেটি ঘাটালে বন্যা প্রতিরোধের একটি রিপোর্ট জমা দেয়। তবে সেই পরিকল্পনায় পরবর্তীতে ভাটা পড়ে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট সরকার এবং ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হওয়ার পর বাম সরকার নড়েচড়ে বসে।
অবশেষে ১৯৮২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাস করেন। কিন্তু তার পরেও এই প্রকল্পের কাজ একটুও এগোয়নি। ঘাটাল সেতুর কাছে স্থাপিত শিলান্যাসের ফলকও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ঘাটালে বন্যায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০০৮ সালে ফের ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়, যেখানে ১৪৬০ কোটি টাকা খরচের একটি খতিয়ান দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার তা পাঠায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, কিন্তু সেই সময় রাজ্যে মাওবাদী সমস্যা এবং পালাবদলের প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ায় বিষয়টি আর এগোয়নি।
BSNL 395 Days New Plan:১৩ মাসের প্ল্যানে ঝড় তুলল সরকারি টেলিকম সংস্থা বিএসেনেল BSNL
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ফের কেন্দ্রীয় সংস্থা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে, কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েনে ফের ধামাচাপা পড়ে যায় বিষয়টি। ২০১৪ সালে ঘাটালের সাংসদ নির্বাচিত হন অভিনেতা দেব ওরফে দীপক অধিকারী, যিনি সংসদে ফের আওয়াজ তোলেন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৭ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত অনুমোদন পায়। তবে সে বছর অর্থ দপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। দীর্ঘ মূল্যায়নের পরে ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১২৩৮.৯৫ কোটি টাকার ছাড়পত্র দেয় এবং প্রকল্পটিকে ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত এলাকা কর্মসূচি’র আওতায় আনার ঘোষণা করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেব জেদ ধরে বসেন যে, ১০ বছরেও ঘাটালবাসীকে মাস্টার প্ল্যান উপহার দিতে পারিনি, তাই আর ভোটে দাঁড়াব না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দেবকে কথা দেন যে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করা হবে।
সাংসদ দেব জানিয়েছেন, “বিগত দশ বছর ধরে লোকসভার সকল অধিবেশনে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে সপক্ষে সওয়াল করে এসেছি। অনেক চেষ্টার পরও কেন্দ্রীয় সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। ২০২৪ সালে রাজ্য সরকারই সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক তৃতীয়াংশ বাজেট (৫০০ কোটি) বরাদ্দ করে”।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে রাজ্য বাজেটে মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়, মোট খরচ ধরা হয় ১৫০০ কোটি টাকা। আগামী তিন বছরের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যেই ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫টি স্লুইস গেটের সংস্কার কাজ এগিয়েছে বেশ কিছুটা।
PMFME ঋণ: ক্ষুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ উদ্যোগের জন্য সুবর্ণ সুযোগ!
প্রকল্পটিতে ৭৮ কিলোমিটার ও ৫২ কিলোমিটার নদীর ড্রেজিং থেকে শুরু করে বাঁধ, ব্রিজ, খাল কাটা, খালের সংস্করণ, কৃত্রিম নদী তৈরি করা এবং জমি অধিগ্রহণ সবই রয়েছে। দেবের মতে, এই কাজের সময়সীমা কমপক্ষে ৪-৫ বছর।
তবে বর্তমানে জমি-জটের কারণে অনেক কাজ থমকে আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি নিয়ে জট কাটাতে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের রুট বদল করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, এই প্রকল্পের জন্য কারোর বসতি যাতে নষ্ট না হয় তা দেখতে হবে এবং প্রয়োজন হলে রুট ঘুরিয়ে দিতে হবে।
সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া জানিয়েছেন, “আমরা ঘাটালে নদীর বাঁধটা যতটা চওড়া করব ভেবেছিলাম তার থেকে যদি একটু কম করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তা হলে দোকান, বাড়ি একটু কম সংখ্যায় নিতে হবে। ঠিক একইভাবে চন্দ্রেশ্বর খাল খননের ক্ষেত্রেও যতটা কম সম্ভব জমি যাতে নেওয়া যায় তাও দেখা হবে”।
বিরোধিতাও রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। দাসপুরে চন্দ্রেশ্বর খাল খনন প্রতিবাদী কমিটি গঠিত হয়েছে। তাদের দাবি, দাসপুর ১ ব্লকের বৈকুণ্ঠপুরের চন্দ্রেশ্বর খাল থেকে সুরতপুর শিলাবতী নদী পর্যন্ত নতুন করে খাল খনন করতে দেওয়া হবে না। কমিটির সম্পাদক হরেকৃষ্ণ জানা বলেছেন যে, এই খালের কোনও উল্লেখ নেই ২০১১ সালে জমা পড়া ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ডিপিআর-এ।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আওতায় রয়েছে দুই মেদিনীপুরের ১২-১৩টি ব্লক ও ৫টি পুর এলাকা। মোট ১২৩ কিলোমিটার নদী ও খাল সংস্কার, পাম্প হাউস তৈরি, প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডওয়াল-সহ নানা কাজ জমি-সমস্যার কারণে থমকে আছে।
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, “আমরা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান করেছি। দু-তিন বছর সময় লাগবে এই প্রকল্প করতে। কিন্তু, আমরা এটা করবই। কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের একটা পয়সাও দেয়নি। আমরা নিজেরাই এই প্রকল্প করছি”।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র নায়কের মতে, একাধিকবার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দেওয়া হলেও কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েনের কারণে কাজ এগোয়নি। যদিও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে পলাশপাই ও দুর্বাচটি সমেত একাধিক খাল সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু শিলাবতী নদীর সংস্কার করা হয়নি।
এদিকে, চলতি বছরের বর্ষায় আবারও বন্যার কবলে পড়েছে ঘাটাল। স্থানীয় বাসিন্দা অবনী চয়ন বলেছেন, “এখন যানবাহন কোনও কিছু চলছে না, আমরা তো সব গৃহবন্দি। সব ঘরবন্দি হয়ে আছি। এখানে এই ছাতি পর্যন্ত জল ছিল”।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান মনিটরিং কমিটির অন্যতম সদস্য আশিস হুদাইত জানিয়েছেন, “মোট ১২৩ কিলোমিটার নদী ও খাল সংস্কার, পাম্প হাউস তৈরি, প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডওয়াল-সহ নানা কাজ জমি-সমস্যার কারণে থমকে আছে। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে এবং সেচমন্ত্রী মানসরঞ্জন ভুঁইয়ার তৎপরতায় ধীরে ধীরে সব কাজ হবে”।