Gitabitan Rabindra Sangeet school: রবীন্দ্রসঙ্গীত বাঙালি সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এই গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে কলকাতার এমনই একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান – ‘গীতবিতান’। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার জন্য কলকাতায় সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত সাংগীতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ১২, প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, বকুল বাগান, ভবানীপুরে এর স্থায়ী ঠিকানা হলেও, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে বর্তমান ঠিকানায় স্থায়ী হওয়া পর্যন্ত ‘গীতবিতান’ বেশ কয়েকটি ভাড়া বাড়িতে তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
গীতবিতানের ঐতিহাসিক যাত্রা
‘গীতবিতান’ শুধু একটি সাংগীতিক প্রতিষ্ঠানই নয়, এটি শতাব্দী জুড়ে বাঙালি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। যখন আমরা গীতবিতান নামটি শুনি, তখন দুটি অর্থ আমাদের মনে আসে – একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত গানের সংকলন গ্রন্থ, অন্যটি হল এই ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রারম্ভিক দিনে এর কার্যক্রম ছিল সীমিত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর পরিধি ও জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান হয়েছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং গীতবিতানের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু একটি সঙ্গীতধারা নয়, এটি একটি জীবনদর্শন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনকালে প্রায় ২,২৩০টি গান রচনা করেছিলেন, যা ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি ১৯৩১ সালে (আশ্বিন, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) প্রথম দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ১৯৪২ সালে (মাঘ, ১৩৪৮) গীতবিতান গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এই গ্রন্থের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা ও প্রচারে নিবেদিত। এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল তত্ত্ব ও প্রয়োগ শেখায়, যাতে তারা রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও ভাবনাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়
রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান গ্রন্থে গানগুলিকে নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে:
- পূজা
- স্বদেশ
- প্রেম
- প্রকৃতি
- বিচিত্র
- আনুষ্ঠানিক
- গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য
- ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
- জাতীয় সংগীত
- পরিশিষ্ট
গীতবিতান প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এই সমস্ত পর্যায়ের গানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে পারে।
গীতবিতানের শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এর শিক্ষাপদ্ধতি অত্যন্ত সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখে।
গীতবিতানের শিক্ষাপদ্ধতিতে মৌলিক সুরের জ্ঞান, স্বরলিপি পাঠ, অভিব্যক্তির গুরুত্ব এবং শব্দার্থ অনুধাবনের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা প্রথমে সহজ গান দিয়ে শুরু করে, ধীরে ধীরে জটিল গানের দিকে অগ্রসর হয়। প্রতিটি পাঠে তত্ত্বীয় এবং ব্যবহারিক উভয় দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
পাঠ্যক্রম সংক্ষেপে:
- প্রারম্ভিক স্তর: মৌলিক সুর ও লয়, প্রাথমিক স্বরলিপি পাঠ, সহজ রবীন্দ্রসঙ্গীত
- মধ্যম স্তর: জটিল লয় ও তাল, মাত্রা ও ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান, মধ্যম জটিলতার গান
- উচ্চ স্তর: জটিল রবীন্দ্রসঙ্গীত, তালের বৈচিত্র্য, অভিব্যক্তির সূক্ষ্মতা, রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও ভাবাদর্শ
গীতবিতানের ঐতিহাসিক অবদান
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার ও সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন।
গীতবিতান প্রতিষ্ঠান নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা এবং কর্মশালার আয়োজন করে, যা শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয়। এছাড়া, এই প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন এবং তিরোধান দিবসে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবন ও গীতবিতান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত জীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাঁর সঙ্গীত জীবনের শুরু হয়েছিল অতি অল্প বয়স থেকেই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সঙ্গীতচর্চার ব্যাপক প্রচলন ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য দাদারা নিয়মিত সংগীতচর্চা করতেন। কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতশিক্ষায় সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম রচিত গান “গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে” যা ১৮৭৫ সালে তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে রচনা করেন। এরপর ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি গান রচনা করে গেছেন। তাঁর সর্বশেষ গান “হে নূতন দেখা দিক আর বার” ১৯৪১ সালে তাঁর জীবদ্দশায় শেষ জন্মদিনে পরিবেশিত হয়েছিল।
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ রবীন্দ্রনাথের এই সমৃদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের রবীন্দ্রনাথের গান শেখাবার পাশাপাশি তাঁর জীবন ও দর্শন সম্পর্কেও অবহিত করে, যাতে তারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মর্ম যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
কলকাতার সাংগীতিক ঐতিহ্যে গীতবিতানের অবস্থান
কলকাতার সাংগীতিক ঐতিহ্যে গীতবিতানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন ‘দক্ষিণী’, ‘বাণীচক্র’, ‘শ্রাবণী সেন মিউজিক স্কুল’, ‘সুরঝঙ্কার’ ইত্যাদি। এই সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এর রয়েছে বিশেষ স্থান।
বর্তমানে ভবানীপুরের ১২, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানোর স্থানই নয়, এটি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনের প্রচার কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। এখানে শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে সাথে তাঁর সাহিত্য, চিন্তাধারা ও জীবনদর্শন সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করে।
আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব বাঙালি সংস্কৃতিতে ক্রমবর্ধমান, তখন কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এর মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠান নতুন প্রজন্মকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সৌন্দর্য ও গভীরতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করছে।
গীতবিতান প্রতিষ্ঠানের অবদানে, রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও বাঙালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়তা ও সম্মান অর্জন করে আছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নতুন ভাবে উপস্থাপন করছেন, তবে তার মূল ভাব ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখে।
কলকাতার প্রথম রবিগান শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’ এর মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিচয়কে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করছে। এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সমৃদ্ধ করছে। আশা করা যায়, আগামী দিনেও গীতবিতান এই মহান কাজ অব্যাহত রাখবে এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের আলো ছড়িয়ে দিতে থাকবে।