Google তার উন্নত AI প্ল্যাটফর্ম Gemini-এর মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় ভারতীয় ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো স্থানীয় ভাষা ও উপভাষায় ভয়েস এবং টেক্সট সার্চের সুবিধা দেওয়া, যাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য তথ্যের ব্যবধান কমানো যায়।
Google-এর এই উদ্যোগ শুধুমাত্র ২২টি স্বীকৃত ভারতীয় ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে আরও অনেক ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই প্রচেষ্টা সেইসব ভাষার ডিজিটাল সংরক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরে যেগুলোর অনলাইনে কোনো উপস্থিতি নেই।
Google DeepMind-এর ডিরেক্টর মনীষ গুপ্ত জানিয়েছেন, তাদের মূল লক্ষ্য হলো AI-কে সবার জন্য উপযোগী করে তোলা। তিনি বলেন, “আমরা কীভাবে AI-কে এমনভাবে বিকশিত করতে পারি যাতে এর সুবিধা সবাই পায়, বিশেষ করে ভারতের এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ? এই লক্ষ্যে আমরা ভাষার দিকে মনোযোগ দিয়েছি, কারণ ভাষা AI-এর ক্ষমতা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করে।”
Google-এর এই প্রকল্প ইতিমধ্যে ৫৯টি ভারতীয় ভাষায় পৌঁছেছে, যার মধ্যে ১৫টি ভাষার কোনো ডিজিটাল উপস্থিতি ছিল না এবং ব্যবহার কমে যাচ্ছিল। এই ১৫টি ভাষার মধ্যে রয়েছে:
1. মালবানি (মহারাষ্ট্রের সিন্ধুদুর্গ জেলায় বলা কোঙ্কণি উপভাষা)
2. শেখাওয়াতি (রাজস্থানের শেখাওয়াতি অঞ্চলের রাজস্থানি উপভাষা)
3. দুরুয়া (মূলত ওড়িশা, আন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বলা দ্রাবিড় ভাষা)
4. বিয়ারিবাশে (কর্ণাটকের দক্ষিণাংশ ও কেরালার উত্তরাংশে বিয়ারি সম্প্রদায়ের বলা স্বতন্ত্র ভাষা)
5. কুদুখ (ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে কুরুখ জনগোষ্ঠীর বলা দ্রাবিড় ভাষা)
6. বজ্জিকা (বিহারের কিছু অংশে বলা ভাষা)
7. রাজবংশী (পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলাদেশের কিছু অংশে বলা ইন্দো-আর্য ভাষা)
8. অঙ্গিকা (বিহার ও ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে বলা ইন্দো-আর্য ভাষা)
এই প্রকল্পের মাধ্যমে Google চেষ্টা করছে যাতে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ সহজেই নিজেদের ভাষায় ভয়েস সার্চ করে Gemini AI প্ল্যাটফর্ম থেকে সঠিক ও মূল্যবান তথ্য পেতে পারেন। এছাড়াও লাইভ অনুবাদ এবং YouTube-এর মাধ্যমে নিজেদের সম্প্রদায়ের সাথে আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারবেন।
ভারতে ভাষার বিলুপ্তির হার উদ্বেগজনক। UNESCO-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১৯৭টি ভাষা বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি। ভাষা সংরক্ষণবাদী গণেশ দেবী জানিয়েছেন, ১৯৬১ সাল থেকে ভারত ২২০টি ভাষা হারিয়েছে এবং আগামী ৫০ বছরে আরও ১৫০টি ভাষা বিলুপ্ত হতে পারে।
ভাষাবিদ পঙ্কজন মোহান্তি বলেন, “আমরা ভাষাগত বৈচিত্র্যের সাথে কীভাবে মোকাবিলা করব তা এখনও ঠিক করতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
ভাষা বিলুপ্তির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
1. সরকার ১০,০০০ এর কম বক্তা সংখ্যা বিশিষ্ট ভাষাকে স্বীকৃতি দেয় না
2. সম্প্রদায়ের অভিবাসন যা ঐতিহ্যবাহী বসতিকে ছড়িয়ে দেয়
3. কর্মসংস্থানের ধরণের পরিবর্তন যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাকে প্রাধান্য দেয়
4. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন
5. “ব্যক্তিবাদের” বিকাশ, যা সম্প্রদায়ের চেয়ে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়
6. ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়ে ভোগবাদের প্রভাবে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মূল্যবোধের অবনতি
মস্তিষ্কের মহাকাব্য: আপনার সন্তানের প্রতিভা বিকাশের ১০টি অমোঘ কৌশল
ভাষা বাঁচানোর জন্য যা করা প্রয়োজন:
1. সংখ্যালঘু (আদিবাসী) ভাষায় শিক্ষাদানকারী বিদ্যালয় গড়ে তোলা, যা বক্তাদের ভাষা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম করবে
2. প্রজেক্ট টাইগারের মতো একটি বৃহৎ ডিজিটাল প্রকল্প শুরু করা যা ভারতের বিপন্ন ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ ও বিকশিত করবে
3. গল্প বলা, লোক সাহিত্য ও ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর অডিও-ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন করা
4. Global Language Hotspots-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের বিদ্যমান কাজকে ব্যবহার করে এই ডকুমেন্টেশন প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করা
ভারত সরকার ২০১৩ সালে বিপন্ন ভাষা সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প (SPPEL) চালু করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের যেসব ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে বা নিকট ভবিষ্যতে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোকে নথিভুক্ত ও সংরক্ষণ করা। এই প্রকল্পটি মাইশোরের Central Institute of Indian Languages (CIIL) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
Google-এর এই উদ্যোগ ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে শুধু ভাষাই নয়, বরং সেই ভাষার সাথে জড়িত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জ্ঞানভাণ্ডারও রক্ষা পাবে। তবে এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে হলে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষক ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি সংস্কৃতির প্রাণ। তাই প্রতিটি ভাষা বাঁচিয়ে রাখা মানে সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা।