গুগল সম্প্রতি একটি বড় ঘোষণা দিয়েছে, যা স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে চলেছে। এই ঘোষণা অনুযায়ী, গুগল তাদের জনপ্রিয় ভার্চুয়াল সহকারী Google Assistant-কে বিদায় জানিয়ে তার জায়গায় Gemini AI-কে নিয়ে আসছে। এই পরিবর্তনটি ২০২৫ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে এখন যে সহকারীটি কথা বলে সাহায্য করে, সেটি আর থাকছে না। তার বদলে আসছে আরও উন্নত, বুদ্ধিমান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দ্বারা চালিত Gemini, যা ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
এই ঘটনার পেছনের পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। গুগল গত ১৪ মার্চ, ২০২৫-এ একটি ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি একটি ‘প্ল্যাটফর্ম শিফট’ বা প্ল্যাটফর্মের বড় পরিবর্তন। Google Assistant, যিনি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের সঙ্গী হয়ে এসেছেন, তাকে এখন অবসর দেওয়া হচ্ছে। তার জায়গায় Gemini AI আসছে, যা গুগলের নতুন প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির একটি উদাহরণ। এই পরিবর্তন শুধু ফোনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং ট্যাবলেট, গাড়ির সিস্টেম, হেডফোন এবং অন্যান্য সংযুক্ত ডিভাইসেও Gemini-কে প্রধান সহকারী হিসেবে দেখা যাবে। গুগলের দাবি, এটি একটি আপগ্রেড, যা ব্যবহারকারীদের জন্য আরও স্মার্ট এবং দ্রুত সেবা নিয়ে আসবে।
কিন্তু এই পরিবর্তনটি ঠিক কীভাবে কাজ করবে? গুগল জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বেশিরভাগ অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে Google Assistant বন্ধ হয়ে যাবে। যদি আপনার ফোনটি Android 10 বা তার থেকে নতুন ভার্সনে চলে এবং কমপক্ষে ২ জিবি RAM থাকে, তাহলে আপনি Gemini-এর সুবিধা পাবেন। এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে শুরু হবে, এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্যবহারকারীদের Google Assistant থেকে Gemini-তে স্থানান্তরিত করা হবে। যারা এখনও পুরোনো ডিভাইস ব্যবহার করছেন, তাদের জন্য এই পরিবর্তনটি হয়তো একটু সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ Gemini-এর জন্য ন্যূনতম হার্ডওয়্যার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে গুগলের মতে, এটি ভবিষ্যতের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ, যেখানে AI-চালিত সহকারীরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ করবে।
Gemini AI আসলে কী এবং এটি Google Assistant থেকে কীভাবে আলাদা? Gemini হলো গুগলের নিজস্ব তৈরি একটি জেনারেটিভ AI মডেল, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। Google Assistant যেখানে সাধারণ কমান্ড যেমন ‘আবহাওয়া বলো’ বা ‘অ্যালার্ম সেট করো’ এর মতো কাজে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে Gemini আরও জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, ছবি বা টেক্সট বিশ্লেষণ করতে পারে এবং এমনকি সৃজনশীল কাজেও সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি বলেন, ‘আমার ইমেল থেকে একটি ইভেন্ট ক্যালেন্ডারে যোগ করো’, Gemini তা সঙ্গে সঙ্গে করে দেবে। এটি শুধু কথা বলাই নয়, বরং ব্যবহারকারীর চাহিদা বুঝে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে।
এই পরিবর্তনের পেছনে গুগলের পরিকল্পনা বোঝা জরুরি। গত কয়েক বছরে AI প্রযুক্তি দ্রুত এগিয়ে গেছে। OpenAI-এর ChatGPT-এর মতো মডেলগুলো যখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তখন গুগলও পিছিয়ে থাকতে চায় না। Gemini-কে তারা এমনভাবে তৈরি করেছে, যাতে এটি ChatGPT-এর মতো প্রতিযোগীদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। আকর্ষণীয় বিষয় হলো, শুধু গুগল নয়, OpenAI নিজেও তাদের ChatGPT-কে অ্যান্ড্রয়েডে ডিফল্ট সহকারী হিসেবে সেট করার সুবিধা চালু করেছে। ফলে, ব্যবহারকারীদের কাছে এখন Gemini এবং ChatGPT-এর মতো বিকল্প থাকবে, যা প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলবে।
ব্যবহারকারীদের জন্য এই পরিবর্তন কী বোঝায়? যারা Google Assistant-এর উপর ভরসা করতেন, তাদের জন্য শুরুতে এটি একটু অসুবিধার মনে হতে পারে। কারণ, Gemini-এর কাজ করার ধরন একটু আলাদা। তবে গুগলের দাবি, এটি ব্যবহারকারীদের জন্য আরও উন্নত অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, Gemini আপনার কথোপকথনের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারে। আপনি যদি বলেন, ‘আমাকে কলকাতার আবহাওয়া বলো’, তারপর বলেন, ‘আর দিল্লিরটা?’—Gemini বুঝতে পারবে আপনি আবহাওয়ার কথাই বলছেন। এ ছাড়া, এটি ছবি বা PDF থেকে তথ্য বের করে দিতে পারে, যা Assistant-এর ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না।
তবে সবকিছু এত সহজ নয়। অনেকে মনে করছেন, এই পরিবর্তন কিছু সমস্যাও তৈরি করতে পারে। যেমন, পুরোনো ফোন ব্যবহারকারীরা Gemini ব্যবহার করতে পারবেন না, যা তাদের জন্য হতাশার কারণ হতে পারে। আবার, Gemini-এর AI-চালিত সিস্টেম বেশি ডেটা ব্যবহার করতে পারে, যা ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল এলাকায় সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া, কেউ কেউ বলছেন, Google Assistant-এর সরলতার সঙ্গে Gemini-এর জটিলতা মেলানো কঠিন হবে। তবে গুগল এই বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে Gemini-কে আরও উন্নত করবে।
এই ঘটনার প্রভাব শুধু ব্যবহারকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তি জগতে এটি একটি বড় ধরনের প্রতিযোগিতার সূচনা করছে। গুগল যখন Gemini-কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন OpenAI-ও ChatGPT-কে আরও শক্তিশালী করছে। ফলে, AI-চালিত সহকারীদের এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে ব্যবহারকারীরা, কারণ তারা আরও উন্নত সেবা পাবেন। গুগলের এই পদক্ষেপকে অনেকে ভবিষ্যতের দিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যেখানে AI আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, গুগলের এই সিদ্ধান্ত স্মার্টফোনের জগতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। Gemini AI-এর আগমনের সঙ্গে আমরা একটি স্মার্ট, দ্রুত এবং বুদ্ধিমান সহকারীর সঙ্গে পরিচিত হব। আপনি যদি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী হন, তাহলে এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হন। Google Assistant-কে বিদায় জানিয়ে Gemini-কে স্বাগত জানানোর সময় এসে গেছে। এই নতুন যুগে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়!