পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন মন্দির সংরক্ষণ, নির্মাণ এবং সংস্কারের খাতে ৭০০ কোটি টাকার বিশাল অঙ্ক ব্যয় করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে এক সাংবাদিক বৈঠকে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র, মন্দির এবং ধর্মীয় স্থানগুলির উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। কালীঘাট মন্দির থেকে শুরু করে দিঘার জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ পর্যন্ত নানা প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এই বিশাল বিনিয়োগ রাজ্যের ধর্মীয় পর্যটন ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান মন্দিরগুলিতে সরকারি বিনিয়োগের চিত্র
পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরের সংস্কার ও উন্নয়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলি হল:
দিঘার জগন্নাথ মন্দির: পুরীর জগন্নাথ ধামের আদলে দিঘায় দেশের দ্বিতীয় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণে রাজ্য সরকার ২০৫-২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। হাউসিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (হিডকো) দ্বারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এপ্রিল মাসে এই মন্দিরের উদ্বোধনের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কালীঘাট মন্দির সংস্কার: ঐতিহ্যবাহী কালীঘাট মন্দিরের সংস্কারে রাজ্য সরকার ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে। একই সঙ্গে রিলায়েন্স গোষ্ঠী মন্দিরের চূড়া ও ভিতরের কিছু অংশের কাজে ৩৫ কোটি টাকা খরচ করছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশা অনুযায়ী, পয়লা বৈশাখের আগেই এই সংস্কার কাজ সম্পূর্ণ হবে।
উত্তরবঙ্গের তীর্থক্ষেত্রগুলির উন্নয়নে গুরুত্ব
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ও ধর্মীয় স্থানেও উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে:
-
ভ্রামরী দেবী মন্দির: উত্তরবঙ্গের এই বিখ্যাত মন্দিরের সংস্কারে উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
-
জল্পেশ মন্দির: ঐতিহাসিক এই মন্দিরের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
-
দেবী চৌধুরানী মন্দির: পুড়ে যাওয়া এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণে সরকারি সাহায্য প্রদান করা হয়েছে।
-
কামতেশ্বরী মন্দির: উত্তরবঙ্গের এই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানের উন্নয়নেও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
-
মদনমোহন মন্দির: কোচবিহারের এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরেরও সংস্কার করা হয়েছে।
এছাড়াও কোচবিহারে আনন্দময়ী ধর্মশালা টেম্পল, বড় দেবীবাড়ি, রাজমাতা মন্দির, শিবদিঘি মন্দির, শিলিগুড়ি আদর্শনগর মন্দিরের উন্নয়নেও রাজ্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করেছে।
দক্ষিণবঙ্গের মন্দিরগুলিতে ব্যয়
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরেও উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী:
-
কচুয়া: ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে
-
চাকনা: ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে
-
তারকেশ্বর: এই প্রসিদ্ধ শিব মন্দিরের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
-
তারাপীঠ: একটি বিখ্যাত শক্তিপীঠ হিসেবে এর উন্নয়নে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে
-
নলহাটেশ্বরী মন্দির: ১ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে
এছাড়াও ফুল্লরা মন্দির, বক্রেশ্বর, কঙ্কালীতলা সতীপিঠ, বর্ধমানে ২১টি শিব মন্দির, বীরভূমে নবরত্ন মন্দির, জয়রামবাটি, কামারহাটি, নন্দকেশ্বরী মন্দিরের উন্নয়নেও সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
ইসকন-সহ অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনার জন্য বরাদ্দ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার মন্দির ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নয়নেও গুরুত্ব দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন:
-
ইসকন: ৭০০ একর জমি দেওয়া হয়েছে নতুন মন্দির নির্মাণের জন্য
-
অনুকুল ঠাকুরের আশ্রম: ৫ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে
-
সার্কিট টুরিজম ডেভেলপমেন্ট: বাঁকুড়া, বীরভূম, নদীয়ার তীর্থস্থানগুলি উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে
এছাড়াও অন্যান্য ধর্মের তীর্থস্থানগুলির উন্নয়নেও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। ওয়াহিদ আলি সাহেবের ইমামবাড়া কবরস্থান, ঘুটিয়ারি শরিফ, ফুরফুরা শরিফ, কালিম্পংয়ের গ্রাহাম হোমস, ষোলআনা মসজিদ এবং ব্যান্ডেল চার্চের সংস্কারেও রাজ্য সরকার অর্থ ব্যয় করেছে।
গঙ্গাসাগর মেলার উন্নয়ন ও কেন্দ্রীয় স্বীকৃতির দাবি
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গঙ্গাসাগর মেলার উন্নয়নে ৩৬ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে, বিশেষত আলোকসজ্জার জন্য। এই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গঙ্গাসাগর মেলার জন্য বিশেষ অনুদান ও স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “কুম্ভমেলাকে কেন্দ্রের স্বীকৃতি দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। কুম্ভমেলা পাওয়া ভাল কথা। তবে কুম্ভমেলা অনেকদিন পরপর হয়। গঙ্গাসাগর মেলা প্রতিবছর হয়। উত্তরপ্রদেশ পেতে পারলে বাংলারও পাওয়া উচিত। গঙ্গাসাগরের মেলাও স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।”
মন্দির উন্নয়নে খরচের বিতর্ক
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভিন্ন মহলে চর্চা ও বিতর্ক রয়েছে। বিশেষত দিঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়কে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে তুলনামূলক একটি তথ্য হল: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যথাক্রমে ২৫ ও ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের প্রায় ১০ গুণ।
২০২৪ সালের আগস্টে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাজ্য উচ্চশিক্ষা দপ্তরকে চিঠি লিখে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কারণ বর্তমান বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে অপ্রতুল।
কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় রাজ্যের পদক্ষেপ
কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত প্রাচীন মন্দিরগুলির সংরক্ষণ ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খরচ অনেক বেশি। ডেটা.গভ.ইন থেকে জানা যায়, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত প্রাচীন মন্দিরগুলির সংরক্ষণ ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ তুলনামূলকভাবে কম।
অন্যদিকে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৮ বছরে রাজ্য সরকার মন্দির সংরক্ষণে ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে। বিধানসভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৩৫০ কোটি টাকা ১৫৭টি প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে বা বরাদ্দ করা হয়েছে, এবং রাজ্য সরকার এই অর্থ সম্পূর্ণভাবে নিজেদের তহবিল থেকে প্রদান করেছে।
ধর্মীয় পর্যটন বিকাশে সরকারি উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, রাজ্য সরকার ধর্মীয় পর্যটন বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলতে চাইছেন।
তিনি বলেছেন, “বাংলা সব জাতির সব ধর্মের সব জাতির তীর্থের মিলনক্ষেত্র।” এই পদক্ষেপগুলি সার্কিট টুরিজম ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে রাজ্যের পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, রাজ্য সরকার ধর্মীয় স্থানগুলির উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ৭০০ কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগ রাজ্যের বিভিন্ন মন্দির, তীর্থস্থান ও ধর্মীয় পরিসরের উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে। এই ধরনের বিনিয়োগ যেমন একদিকে পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করবে, তেমনি ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণেও সাহায্য করবে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মীয় স্থান সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি এই গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলিতেও সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। যাইহোক, রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।