১০০ বছরের অপেক্ষার অবসান: পশ্চিমবঙ্গে নতুন মৌজা মানচিত্র তৈরির যুগান্তকারী উদ্যোগ

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০০ বছর পর আবারও মৌজা মানচিত্র বা ক্যাডাস্ট্রাল ম্যাপ তৈরির কাজ শুরু হতে চলেছে। এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের মাধ্যমে রাজ্যের ভূমির বর্তমান চিত্র ফুটে উঠবে, যা গত শতাব্দীতে বড়…

Ishita Ganguly

 

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০০ বছর পর আবারও মৌজা মানচিত্র বা ক্যাডাস্ট্রাল ম্যাপ তৈরির কাজ শুরু হতে চলেছে। এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের মাধ্যমে রাজ্যের ভূমির বর্তমান চিত্র ফুটে উঠবে, যা গত শতাব্দীতে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। নবান্ন সূত্রে জানা গেছে, শেষবার এই ধরনের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল ১৯২৫ সালে। এরপর থেকে রাজ্যের জমির ব্যবহার, গ্রামীণ এলাকার শহরে রূপান্তর এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে পুরনো মানচিত্র আর বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে না। তাই আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন করে এই মানচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।

এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রয়োজনীয়তা। ১৯২৫ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে কোনো বড় আকারে মৌজা মানচিত্র তৈরি বা আপডেট করা হয়নি। এই সময়ের মধ্যে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, রাজ্যে বিভিন্ন সরকার এসেছে, কিন্তু ভূমি-সংক্রান্ত এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে অনেক এলাকায় জমির চরিত্র পাল্টে গেছে—কোথাও গ্রাম শহরে পরিণত হয়েছে, কোথাও কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানা, আবার কোথাও নতুন রাস্তা, রেললাইন বা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে।

আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সহজ হল জমি পরিমাপ

এই পরিবর্তনগুলো সরকারি রেকর্ডে না থাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমস্যা হচ্ছিল। তিন ধাপে এই সমীক্ষা চালানো হবে—প্রথমে হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও পূর্ব বর্ধমান; দ্বিতীয় ধাপে দুই ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম ও নদিয়া; এবং তৃতীয় ধাপে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, কালিম্পং ও দার্জিলিং জেলায় কাজ হবে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই মানচিত্র তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। হাই-রেজোলিউশন স্যাটেলাইট ইমেজ এবং ড্রোন ক্যামেরার মাধ্যমে জমির বিস্তারিত চিত্র ধরা হবে। এছাড়া প্রতিটি মৌজায় সশরীরে গিয়ে তথ্য যাচাই করা হবে, যাতে কোনো ভুল না থাকে। রাজ্যের ‘ডিরেক্টরেট অফ ল্যান্ড রেকর্ডস অ্যান্ড সার্ভে’ বিভাগ এই কাজের তত্ত্বাবধান করছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২,৩০২টি মৌজা রয়েছে। বড় মৌজাগুলোর জন্য একাধিক মানচিত্র তৈরি হবে, ফলে মোট সিএস ম্যাপের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮,৪৫৩টি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু জমির ব্যবহারই নয়, মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য ভেক্টর সার্ভেও করা হবে।

এই উদ্যোগের গুরুত্ব অনেক। পশ্চিমবঙ্গের ভূমি ব্যবহারের একটি পরিষ্কার ও আধুনিক ছবি সরকারের হাতে থাকলে উন্নয়নের পরিকল্পনা অনেক সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, রাজারহাট-নিউটাউন এলাকা একসময় মাছের ভেরি ছিল, কিন্তু এখন সেখানে আধুনিক শহর গড়ে উঠেছে। আবার মালদা বা মুর্শিদাবাদে অনেক কৃষিজমি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে, কিন্তু পুরনো মানচিত্রে তা এখনও দেখানো আছে। নতুন মানচিত্রে এসব ভুল সংশোধন হবে। এছাড়া কৃষি, আবাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলপথ—সবকিছুর সঠিক তথ্য সরকারের কাছে থাকবে, যা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সাহায্য করবে। এই প্রকল্প শেষ হলে রাজ্যের ভূ-মানচিত্র একেবারে বদলে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সব মিলিয়ে, এটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই নতুন মৌজা মানচিত্র রাজ্যের জমির বর্তমান অবস্থা পরিষ্কার করে দেবে। ফলে সরকারের উন্নয়ন কাজে গতি আসবে, আর মানুষের জীবনযাত্রাও আরও উন্নত হবে। বিশ্বস্ত সূত্র যেমন নবান্ন এবং ‘ডিরেক্টরেট অফ ল্যান্ড রেকর্ডস অ্যান্ড সার্ভে’-এর তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রকল্পকে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলা যায়। ১০০ বছর পর এই কাজ শুরু হওয়ায় অনেকেই আশা করছেন, এটি রাজ্যের ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।