আন্তর্জাতিক মেধা আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে এবার নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে চীন। আমেরিকার জনপ্রিয় H-1B ভিসার বিকল্প হিসেবে চীন চালু করতে চলেছে ‘K ভিসা’, যা বিশ্বের তরুণ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী এবং গণিতজ্ঞদের (STEM) জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যখন আমেরিকা তাদের ভিসা নীতি কঠোর করছে, ঠিক সেই সময়ে চীনের এই পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে মেধাবী পেশাজীবীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা চীনের নতুন এই ভিসা নীতি (China’s H-1B alternative), এর যোগ্যতা, সুবিধা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন চীন এই নতুন ভিসা চালু করছে?
বিগত কয়েক দশক ধরে আমেরিকা, বিশেষ করে তাদের সিলিকন ভ্যালি, বিশ্বের সেরা মেধাবীদের জন্য স্বপ্নের গন্তব্য ছিল। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল H-1B ভিসা, যা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বিদেশি দক্ষ কর্মীদের নিয়োগের সুযোগ করে দিত। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে H-1B ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া zunehmend জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান নীতিমালায় ভিসা প্রাপ্তির হার কমেছে এবং ফি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি H-1B আবেদনের জন্য এককালীন $100,000 ফি আরোপের প্রস্তাবও করা হয়েছে, যা অনেক কোম্পানি এবং আবেদনকারীর জন্য একটি বড় বাধা।
এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই চীন তাদের ‘K ভিসা’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছে, যা কার্যকর হবে ১ অক্টোবর, ২০২৫ থেকে। চীনের মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকার কঠোর নীতির কারণে হতাশ মেধাবীদের নিজের দেশের দিকে আকৃষ্ট করা এবং দেশের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে আরও গতিশীল করা। চীন সরকারের লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে নিজেদের একটি প্রযুক্তিগত পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, এবং এই লক্ষ্য পূরণে বিদেশি মেধার অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
China’s H-1B Alternative: ‘K ভিসা’ আসলে কী?
‘K ভিসা’ হলো চীনের একটি নতুন ভিসা ক্যাটাগরি, যা বিশেষভাবে তরুণ এবং মেধাবী STEM পেশাজীবীদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। চীনের বিদ্যমান ১২টি সাধারণ ভিসা ক্যাটাগরির বাইরে এটি একটি নতুন সংযোজন। এই ভিসার মূল উদ্দেশ্য হলো তরুণ গবেষক, বিজ্ঞানী এবং উদ্যোক্তাদের চীনে এসে কাজ করা, গবেষণা করা এবং নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য উৎসাহিত করা।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়া (Xinhua) অনুসারে, এই ভিসাটি দেশের “নতুন যুগে কর্মশক্তি উন্নয়ন কৌশল” বাস্তবায়নের একটি অংশ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তরুণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিভাদের চীনে প্রবেশ এবং বিনিময় সহজতর হবে।
‘K ভিসা’র প্রধান সুবিধাগুলো:
- নিয়োগকর্তার স্পনসরশিপের প্রয়োজন নেই: H-1B ভিসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো একজন মার্কিন নিয়োগকর্তার কাছ থেকে স্পনসরশিপ বা চাকরির অফার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু চীনের ‘K ভিসা’র জন্য আবেদনের সময় কোনো চীনা কোম্পানি থেকে চাকরির অফার বা আমন্ত্রণপত্রের প্রয়োজন হবে না। আবেদনকারীরা নিজেদের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সরাসরি আবেদন করতে পারবেন।
- একাধিকবার প্রবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান: ‘K ভিসা’ধারীরা একাধিকবার চীনে প্রবেশ করতে পারবেন এবং তাদের ভিসার মেয়াদও দীর্ঘ হবে। এটি গবেষক এবং উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে সুবিধাজনক, কারণ তাদের কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই দেশের বাইরে যাতায়াত করতে হয়।
- কাজের নমনীয়তা: এই ভিসা নিয়ে চীনে প্রবেশ করে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ভিসা হোল্ডাররা শিক্ষা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, ব্যবসা এবং উদ্যোক্তা কার্যক্রমের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারবেন।
- সহজ আবেদন প্রক্রিয়া: অন্যান্য ওয়ার্ক ভিসার তুলনায় ‘K ভিসা’র আবেদন প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং দ্রুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কাজের অভিজ্ঞতার মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
কারা এই ভিসার জন্য যোগ্য?
যদিও ‘K ভিসা’র জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকা এখনো চীনা দূতাবাসগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি, তবে প্রাথমিক ঘোষণা অনুযায়ী নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন:
- শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিত (STEM) বিষয়ে স্বীকৃত দেশি বা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে।
- পেশাগত অভিজ্ঞতা: উপরিউক্ত ক্ষেত্রগুলিতে কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বা গবেষণার কাজে নিযুক্ত তরুণ পেশাজীবীরাও আবেদন করতে পারবেন।
- বয়স: যদিও বয়সের ঊর্ধ্বসীমা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে ‘তরুণ প্রতিভা’ শব্দগুচ্ছ থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে আবেদনকারীদের বয়স সাধারণত ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে হতে পারে। চীনের ‘ট্যালেন্টেড ইয়ং সায়েন্টিস্ট প্রোগ্রাম’-এ বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৪৫ বছর।
পরিসংখ্যানের আলোকে চীনে বিদেশি কর্মী
HKDCA (Hong Kong Diocesan Commission for Shroffs’ Affairs) এর “2024 – 2025 FOREIGNERS IN CHINA UPDATE” শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, চীনে বিদেশি কর্মীদের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চিত্রে একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো থেকে উচ্চ-দক্ষ পেশাজীবীর সংখ্যা হ্রাস পেলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে কর্মীর আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে, বিদেশিদের চীন সফরের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষে পৌঁছেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩০.২% বেশি। এই পরিবর্তন চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে তার শক্তিশালী সম্পর্কের প্রতিফলন। ‘K ভিসা’ এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞের মতামত: চীনের এই পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনের ‘K ভিসা’ বৈশ্বিক মেধা আকর্ষণের মানচিত্রে একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের (Brookings Institution) একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, চীন প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য মেধাকে “প্রথম সম্পদ” হিসেবে দেখে। ‘K ভিসা’ এই কৌশলেরই একটি অংশ।
তবে, চীনে বিদেশি কর্মীদের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো:
- ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বাধা: ম্যান্ডারিন ভাষা এবং চীনের ব্যবসায়িক সংস্কৃতি পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- তথ্যের স্বাধীনতা এবং সেন্সরশিপ: ইন্টারনেট এবং তথ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অনেক বিদেশি পেশাজীবীর জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
- মেধাস্বত্ব (Intellectual Property) সুরক্ষা: চীনে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে উদ্বেগ এখনও বিদ্যমান, যা গবেষক এবং উদ্ভাবকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও, আমেরিকা এবং ইউরোপের ক্রমবর্ধমান কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে চীন অনেক মেধাবীর জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ভারতীয়দের জন্য, যারা H-1B ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী এবং বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার সম্মুখীন, তাদের জন্য ‘K ভিসা’ একটি নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
H-1B, Z ভিসা এবং R ভিসার সাথে ‘K ভিসা’র পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | US H-1B ভিসা | China Z ভিসা (Work Visa) | China R ভিসা (Talent Visa) | China K ভিসা (Young Talent) |
মূল উদ্দেশ্য | দক্ষ কর্মীদের জন্য অস্থায়ী কাজের ভিসা | চীনে সাধারণ কাজের জন্য ভিসা | উচ্চ-স্তরের এবং শীর্ষস্থানীয় মেধাবীদের জন্য | তরুণ STEM পেশাজীবী ও গবেষকদের জন্য |
স্পনসরশিপ | বাধ্যতামূলক | বাধ্যতামূলক | প্রয়োজন হতে পারে | প্রয়োজন নেই |
আবেদনের ভিত্তি | নিয়োগকর্তার আবেদন | চাকরির চুক্তি | অসামান্য অর্জন, পুরস্কার | শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, অভিজ্ঞতা |
নমনীয়তা | সীমিত (নিয়োগকর্তা-নির্দিষ্ট) | সীমিত (নিয়োগকর্তা-নির্দিষ্ট) | উচ্চ | খুব উচ্চ (বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ) |
লক্ষ্য گروه | বিস্তৃত পেশার দক্ষ কর্মী | বিভিন্ন স্তরের কর্মী | নোবেল বিজয়ী, শীর্ষ বিজ্ঞানী | তরুণ STEM স্নাতক ও গবেষক |
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুপারিশ
‘K ভিসা’ চীনের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধুমাত্র বিদেশি মেধাবীদের আকর্ষণ করবে না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ উদ্ভাবন এবং গবেষণার পরিবেশকেও সমৃদ্ধ করবে। তবে এই কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের উপর। চীনকে বিদেশি কর্মীদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে ভাষাগত সহায়তা, সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রোগ্রাম এবং মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর প্রয়োগ।
যেসব তরুণ মেধাবী পেশাজীবী আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য চীনের ‘K ভিসা’ একটি দারুণ সুযোগ হতে পারে। আবেদন করার আগে চীনের কাজের পরিবেশ, জীবনযাত্রার মান এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে গবেষণা করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
উপসংহার
আমেরিকার H-1B ভিসার একটি শক্তিশালী বিকল্প (China’s H-1B alternative) হিসেবে চীনের ‘K ভিসা’র আত্মপ্রকাশ বিশ্বজুড়ে মেধা প্রবাহের গতিপথ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে। প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড়ে চীন যে কতটা আন্তরিক, এই পদক্ষেপ তারই প্রমাণ। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোর জীবনযাত্রার আকর্ষণ এখনও বেশি, তবে সুযোগ এবং নমনীয়তার বিচারে ‘K ভিসা’ নিঃসন্দেহে বিশ্বের তরুণ মেধাবীদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. চীনের ‘K ভিসা’ কবে থেকে চালু হবে?
চীনের ‘K ভিসা’ ১ অক্টোবর, ২০২৫ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে।
২. ‘K ভিসা’র জন্য আবেদন করতে কি চাকরির অফার লাগবে?
না, ‘K ভিসা’র সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর জন্য কোনো চীনা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে চাকরির অফার বা স্পনসরশিপের প্রয়োজন নেই।
৩. কোন কোন ক্ষেত্রের পেশাজীবীরা ‘K ভিসা’র জন্য আবেদন করতে পারবেন?
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (STEM) ক্ষেত্রের তরুণ পেশাজীবী, স্নাতক এবং গবেষকরা এই ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
৪. ‘K ভিসা’র মেয়াদ কতদিন থাকবে?
‘K ভিসা’ দীর্ঘমেয়াদী এবং একাধিকবার প্রবেশের সুবিধা দেবে। তবে এর সঠিক মেয়াদ এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এটি অন্যান্য ভিসার তুলনায় বেশি নমনীয় হবে।
৫. ভারতীয়দের জন্য কি ‘K ভিসা’ একটি ভালো বিকল্প?
হ্যাঁ, বিশেষ করে যারা আমেরিকার H-1B ভিসার কঠোর নিয়মের কারণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের জন্য চীনের ‘K ভিসা’ একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিকল্প হতে পারে।
৬. ‘K ভিসা’ এবং ‘R ভিসা’র মধ্যে পার্থক্য কী?
‘R ভিসা’ হলো উচ্চ-স্তরের, বিশ্বখ্যাত এবং প্রতিষ্ঠিত মেধাবীদের জন্য (যেমন নোবেল বিজয়ী, শীর্ষ বিজ্ঞানী)। অন্যদিকে, ‘K ভিসা’ বিশেষভাবে তরুণ এবং কর্মজীবনের শুরুতে থাকা STEM মেধাবীদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে।