হাড়জোড়া, যার বৈজ্ঞানিক নাম Cissus quadrangularis (সিসাস কোয়াড্রাঙ্গুলারিস), একটি প্রাচীন ভেষজ উদ্ভিদ যা হাজার হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদিক এবং প্রথাগত ওষুধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর সবচেয়ে পরিচিত ব্যবহার হলো ভাঙা হাড় দ্রুত জোড়া লাগাতে সাহায্য করা, যার জন্য এর নামকরণ হয়েছে ‘অস্থিসংহারক’ (সংস্কৃতে যার অর্থ ‘যা হাড়কে রক্ষা করে’)। তবে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই গাছের আরও অনেক বিস্ময়কর গুণের প্রমাণ দিয়েছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI)-এ প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, হাড়জোড়া শুধু হাড়ের স্বাস্থ্যই নয়, এটি ওজন কমানো, মেটাবলিক সিন্ড্রোম নিয়ন্ত্রণ, জয়েন্টের ব্যথা উপশম এবং এমনকি গ্যাস্ট্রিক আলসারের বিরুদ্ধেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা হাড়জোড়ার ঐতিহ্যগত ব্যবহার থেকে শুরু করে এর পেছনের আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং এটি ব্যবহারের সঠিক নিয়মাবলী নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব।
হাড়জোড়া গাছ: একটি গভীর পরিচিতি
হাড়জোড়া একটি লতানো প্রকৃতির উদ্ভিদ, যা সাধারণত আঙুর পরিবারের (Vitaceae) অন্তর্গত। এটি আফ্রিকা এবং এশিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এর কাণ্ডগুলি চার কোণাবিশিষ্ট এবং রসালো হয়, যা দেখতে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো। এই কাণ্ডগুলোই মূলত ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উদ্ভিদবিদ্যাগত পরিচয় এবং রাসায়নিক উপাদান
হাড়জোড়া গাছটিকে প্রায়শই “ভেল্ডট গ্রেপ” (Veldt Grape) বা “ডেভিল’স ব্যাকবোন” (Devil’s Backbone) বলা হয়। এর ঔষধি গুণের পেছনে রয়েছে এর সমৃদ্ধ রাসায়নিক প্রোফাইল। উদ্ভিদ রসায়নবিদরা এর মধ্যে একাধিক সক্রিয় জৈব যৌগ শনাক্ত করেছেন যা শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।
- কেটোস্টেরন (Ketosterones): এগুলিকে হাড়জোড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় উপাদান বলে মনে করা হয়। এই স্টেরয়েডাল যৌগগুলি সরাসরি অস্টিওব্লাস্ট (osteoblasts) বা হাড় গঠনকারী কোষগুলির কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করে, যা ফ্র্যাকচার নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
- ফ্ল্যাভোনয়েডস (Flavonoids): কোয়ারসেটিন (Quercetin) এবং কেম্পফেরল (Kaempferol) এর মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এতে উপস্থিত, যা শরীরের প্রদাহ (inflammation) কমাতে সাহায্য করে।
- ভিটামিন সি (Vitamin C): এটি একটি অপরিহার্য পুষ্টি যা কোলাজেন (collagen) সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন। কোলাজেন হলো সেই প্রোটিন যা হাড়, তরুণাস্থি এবং অন্যান্য সংযোজক টিস্যুর কাঠামো তৈরি করে।
- ক্যারোটিনয়েডস (Carotenoids): বিটা-ক্যারোটিন সহ অন্যান্য ক্যারোটিনয়েডস, যা শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
- ট্রাইটারপেনয়েডস (Triterpenoids): এই যৌগগুলি তাদের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং বেদনানাশক (analgesic) গুণের জন্য পরিচিত।
প্রথাগত ব্যবহারে এর ইতিহাস
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে, হাড়জোড়াকে ‘অস্থিসংহারক’ বা ‘বজ্রবল্লী’ (বজ্রের মতো শক্তিশালী লতা) বলা হয়। চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতার মতো প্রাচীন গ্রন্থেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
১. আয়ুর্বেদ: প্রথাগতভাবে, ভাঙা হাড়ের জায়গায় হাড়জোড়ার তাজা কাণ্ড বেটে প্রলেপ (poultice) হিসেবে লাগানো হতো। এর পাশাপাশি, এর রস বা ক্বাথ সেবন করতে দেওয়া হতো যাতে ভেতর থেকেও নিরাময় প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। এটি শুধুমাত্র হাড় ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, অস্টিওপোরোসিস (হাড়ের ক্ষয়) এবং দুর্বল হাড়ের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হতো।
২. ইউনানী এবং সিদ্ধা মেডিসিন: এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলিতেও হাড়জোড়াকে বাতের ব্যথা, পিঠের ব্যথা এবং লিগামেন্টের আঘাতের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
৩. আফ্রিকান ঐতিহ্যগত ঔষধ: আফ্রিকার কিছু অংশে, এটি ম্যালেরিয়া, পেটের সমস্যা এবং এমনকি ঋতুস্রাবের ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হতো।
এই গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তিই আধুনিক বিজ্ঞানীদের এই উদ্ভিদটি নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
হাড় জোড়া লাগছে কি না বুঝবেন কীভাবে? জেনে নিন ১০টি লক্ষণ
হাড়জোড়া গাছের প্রধান ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ
যদিও ঐতিহ্যগত ব্যবহারগুলি আশাব্যঞ্জক, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কঠোর প্রমাণ চায়। বিগত দুই দশকে Cissus quadrangularis নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে, যা এর কিছু দাবিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
হাড়ের স্বাস্থ্য এবং ফ্র্যাকচার নিরাময় (এর প্রধান খ্যাতি)
এটিই হাড়জোড়ার সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত উপকারিতা। এর কার্যকারিতার পেছনে একাধিক প্রক্রিয়া জড়িত:
- অস্টিওব্লাস্ট অ্যাক্টিভেশন: গবেষণা দেখায় যে হাড়জোড়ার নির্যাস অস্টিওব্লাস্ট নামক কোষগুলিকে উদ্দীপিত করে, যা নতুন হাড়ের টিস্যু তৈরি করে।
- কোলাজেন সংশ্লেষণ: এতে থাকা ভিটামিন সি এবং অন্যান্য যৌগগুলি ফ্র্যাকচারের জায়গায় কোলাজেন ফাইবার তৈরিতে সাহায্য করে, যা হাড়ের ম্যাট্রিক্স গঠনের প্রাথমিক ধাপ।
- অ্যান্টি-ক্যাটাবলিক এফেক্ট: এটি কর্টিসোল (stress hormone) দ্বারা সৃষ্ট হাড়ের ভাঙ্গন (catabolic effect) কমাতে সাহায্য করে, যা ফ্র্যাকচার নিরাময়ের সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একটি ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফার্মাকোলজি-তে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হাড়জোড়ার নির্যাস গ্রহণ করেছেন, তাদের ফ্র্যাকচার নিরাময়ের সময় প্লাসিবো (placebo) গ্রুপের তুলনায় প্রায় ৩০% থেকে ৫০% পর্যন্ত কমে এসেছে। এটি হাড়ের খনিজ ঘনত্ব (Bone Mineral Density – BMD) বাড়াতেও সাহায্য করে।
অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ
অস্টিওপোরোসিস এমন একটি রোগ যেখানে হাড়গুলি ভঙ্গুর হয়ে যায়। এটি বিশেষত মেনোপজ-পরবর্তী মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। হাড়জোড়ার নির্যাস ইস্ট্রোজেনের মতো হালকা প্রভাব ফেলে এবং ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়াতে সাহায্য করে। সায়েন্সডাইরেক্ট (ScienceDirect)-এ প্রকাশিত পশুদের উপর করা গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি হাড়ের ক্ষয় উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ করতে পারে, যা অস্টিওপোরোসিসের চিকিৎসায় একটি সহায়ক থেরাপি হিসেবে এর সম্ভাবনা তুলে ধরে।
ওজন ব্যবস্থাপনা এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোম
এটি হাড়জোড়ার একটি অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কৃত গুণ। গত এক দশকে, Cissus quadrangularis ওজন কমানোর সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এর কার্যপ্রণালী বেশ জটিল:
১. ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট ব্লকিং: হাড়জোড়া লাইপেজ (lipase) এবং অ্যামাইলেজ (amylase) নামক হজমকারী এনজাইমগুলিকে বাধা দিতে পারে। এর ফলে শরীর খাদ্য থেকে কম চর্বি এবং শর্করা শোষণ করে।
২. ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ: মনে করা হয় এটি মস্তিষ্কের সেরোটোনিন (serotonin) লেভেলকে প্রভাবিত করে, যা ক্ষুধা এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে।
৩. মেটাবলিজম বুস্ট: এটি শরীরের বিপাকীয় হার বাড়াতে সাহায্য করে, যার ফলে শরীর আরও বেশি ক্যালোরি পোড়ায়।
লিপিডস ইন হেলথ অ্যান্ড ডিজিজ (Lipids in Health and Disease) জার্নালে প্রকাশিত একটি যুগান্তকারী ডাবল-ব্লাইন্ড, প্লাসিবো-নিয়ন্ত্রিত গবেষণায়, স্থূল এবং অতিরিক্ত ওজনের ব্যক্তিদের একটি দলকে প্রতিদিন হাড়জোড়ার নির্যাস (CQR-300 নামক একটি নির্দিষ্ট পেটেন্ট নির্যাস) দেওয়া হয়েছিল। ৮ সপ্তাহ পরে, দেখা গেছে:
- ওজন হ্রাস: প্লাসিবো গ্রুপের তুলনায় তাদের ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
- কোলেস্টেরল: মোট কোলেস্টেরল এবং এলডিএল (LDL) বা “খারাপ” কোলেস্টেরলের মাত্রা কমেছে।
- রক্তে শর্করা: ফাস্টিং ব্লাড সুগারের মাত্রাও কমেছে।
এই ফলাফলগুলি দেখায় যে হাড়জোড়া শুধুমাত্র ওজন কমাতেই সাহায্য করে না, বরং এটি মেটাবলিক সিন্ড্রোমের (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার সম্মিলিত ঝুঁকি) বিরুদ্ধেও লড়াই করতে পারে।
ওজন কমানোর গবেষণার তুলনামূলক সারণী (৮ সপ্তাহের ট্রায়াল)
| প্যারামিটার | প্লাসিবো গ্রুপ (পরিবর্তন) | হাড়জোড়া নির্যাস গ্রুপ (পরিবর্তন) |
| শরীরের ওজন | – ১.৫ কেজি | – ৭.৯ কেজি |
| বডি ফ্যাট | – ১.২% | – ১০.৬% |
| মোট কোলেস্টেরল | – ২.১% | – ২২.৭% |
| ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ | – ০.৮% | – ১৪.৩% |
(দ্রষ্টব্য: উপরের ডেটাগুলি উল্লিখিত গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সরলীকৃত উদাহরণ।)
জয়েন্টের ব্যথা এবং আর্থ্রাইটিস
হাড়জোড়ার শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহ-বিরোধী) বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ট্রাইটারপেনয়েডগুলি সাইক্লোঅক্সিজেনেস (COX) এনজাইমগুলির কার্যকলাপকে বাধা দেয়, যা ব্যথানাশক ওষুধ (যেমন আইবুপ্রোফেন) যেভাবে কাজ করে তার অনুরূপ।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে। এটি জয়েন্টের ফোলাভাব, শক্ত হয়ে যাওয়া এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অনেক ক্রীড়াবিদ এবং যারা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করেন, তারা জয়েন্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং আঘাত থেকে দ্রুত সেরে উঠতে হাড়জোড়ার সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করেন। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মেডিকেল সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ব্যায়াম-জনিত জয়েন্টের ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাড়জোড়া সেবন করার পর ব্যথার উপশম অনুভব করেছেন এবং তাদের জয়েন্টের কার্যকারিতা উন্নত হয়েছে।
অন্যান্য সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা
গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, হাড়জোড়ার আরও কিছু সম্ভাবনাময় দিক উন্মোচিত হচ্ছে:
- গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রতিরোধ: হাড়জোড়ার নির্যাস পাকস্থলীর মিউকোসাল আস্তরণকে রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং অ্যাসিড নিঃসরণ কমায়। এটি অ্যাসপিরিন বা অন্যান্য NSAID (নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ) দ্বারা সৃষ্ট আলসারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব দেখিয়েছে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য: এর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস এবং ফ্ল্যাভোনয়েডস শরীরকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যা বার্ধক্য প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়।
- অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল: ল্যাবরেটরি গবেষণায় দেখা গেছে যে এর নির্যাস কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া (যেমন E. coli) এবং ছত্রাকের বিরুদ্ধে কার্যকরী।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার গভীর বিশ্লেষণ
একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, যদিও হাড়জোড়া নিয়ে অনেক ইতিবাচক গবেষণা হয়েছে, তার বেশিরভাগই পশুদের উপর (pre-clinical) বা ছোট আকারের মানব ট্রায়াল (clinical trials) ছিল।
শরীরে কোলাজেনের ঘাটতি? ত্বক ঝুলে পড়বে, চুল ঝরবে, হাড় হবে দুর্বল!
হাড় নিরাময়ে গবেষণার সীমাবদ্ধতা
বেশিরভাগ ফ্র্যাকচার নিরাময়ের গবেষণা ইঁদুর বা খরগোশের উপর করা হয়েছে। যদিও ফলাফলগুলি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক, মানবদেহে এর কার্যকারিতা ঠিক একইভাবে হবে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য আরও বড়, বহু-কেন্দ্রিক (multi-centric) র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (RCTs) প্রয়োজন। মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টার (Memorial Sloan Kettering Cancer Center)-এর মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলিও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য এর ব্যবহারকে “সম্ভাব্য” (promising) বলে উল্লেখ করে, তবে চূড়ান্ত চিকিৎসা সুপারিশের জন্য আরও প্রমাণের অপেক্ষায় রয়েছে।
ওজন কমানোর গবেষণার বাস্তবতা
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে গবেষণাগুলি, বিশেষ করে Cissus quadrangularis (CQR-300) এর পেটেন্ট নির্যাস ব্যবহার করে করা গবেষণাগুলি, বেশ শক্তিশালী। এই ট্রায়ালগুলি ডাবল-ব্লাইন্ড এবং প্লাসিবো-নিয়ন্ত্রিত ছিল, যা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এই সাপ্লিমেন্টগুলি প্রায়শই একটি ক্যালোরি-নিয়ন্ত্রিত ডায়েট এবং ব্যায়ামের সাথে মিলিতভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল। হাড়জোড়া কোনো “ম্যাজিক পিল” নয়; এটি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারার সহায়ক হিসেবে সবচেয়ে ভালো কাজ করে।
হাড়জোড়া গাছ কিভাবে ব্যবহার করবেন?
হাড়জোড়া বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং এর ব্যবহার নির্ভর করে কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর।
প্রথাগত পদ্ধতি (Traditional Methods)
- তাজা পেস্ট (Poultice): ফ্র্যাকচার বা মচকে যাওয়ার জায়গায় তাজা হাড়জোড়ার কাণ্ড পিষে সরাসরি প্রলেপ দেওয়া হয়। ব্যথা এবং ফোলা কমাতে এটি এখনও গ্রামীণ ভারতে একটি সাধারণ অভ্যাস।
- রস (Juice): কাণ্ড থেকে রস বের করে তা (সাধারণত ১০-২০ মিলি) দিনে একবার বা দুবার সেবন করা হয়।
- চাটনি বা রান্না: দক্ষিণ ভারতে, এর কচি কাণ্ডগুলি চাটনি তৈরি করতে বা অন্যান্য সবজির সাথে রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
আধুনিক পরিপূরক (Modern Supplements)
সহজে সেবনের জন্য, হাড়জোড়া এখন বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত ফর্মে পাওয়া যায়:
- পাউডার (Powder): শুকনো কাণ্ড গুঁড়ো করে পাউডার তৈরি করা হয়, যা জল বা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।
- ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট (Capsules/Tablets): এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম। এগুলিতে সাধারণত ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ৭৫০ মিলিগ্রাম হাড়জোড়ার নির্যাস থাকে।
- তরল নির্যাস (Liquid Extract): অ্যালকোহল বা গ্লিসারিনে তৈরি করা ঘনীভূত নির্যাস।
প্রস্তাবিত ডোজ (Recommended Dosage)
যেহেতু এটি একটি ভেষজ সাপ্লিমেন্ট, তাই এর কোনো কঠোর “অফিসিয়াল” ডোজ নেই। তবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত ডোজগুলির উপর ভিত্তি করে একটি সাধারণ নির্দেশিকা দেওয়া যেতে পারে:
- হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য: প্রতিদিন ১.২ গ্রাম থেকে ৩ গ্রাম পর্যন্ত হাড়জোড়ার পাউডার বা সমতুল্য নির্যাস, বিভক্ত ডোজে।
- ওজন কমানোর জন্য: গবেষণায় সাধারণত ৩০৯ মিলিগ্রাম থেকে ১০২০ মিলিগ্রাম নির্যাস (যেমন CQR-300) খাবারের ৩০ মিনিট আগে দিনে দুবার ব্যবহার করা হয়েছে।
- জয়েন্টের ব্যথার জন্য: প্রতিদিন প্রায় ৩০০-৬০০ মিলিগ্রাম নির্যাস।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা: যেকোনো নতুন সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে অবশ্যই একজন ডাক্তার বা যোগ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে পরামর্শ করা উচিত। তারা আপনার বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং অন্যান্য ওষুধের সাথে এর সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়া (interactions) বিবেচনা করে সঠিক ডোজ সুপারিশ করতে পারবেন।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং সতর্কতা
স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারে হাড়জোড়াকে সাধারণত “সম্ভবত নিরাপদ” (Possibly Safe) বলে মনে করা হয়। WebMD-এর মতে, বেশিরভাগ মানুষ এটি ভালোভাবে সহ্য করতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে হালকা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন:
- মাথাব্যথা
- পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি
- শুষ্ক মুখ
- বমি বমি ভাব
- অনিদ্রা (Insomnia)
কাদের এড়িয়ে চলা উচিত?
নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হাড়জোড়া ব্যবহার না করাই ভালো:
১. গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলা: এই শ্রেণীর উপর পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
২. ডায়াবেটিস রোগী: হাড়জোড়া রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পারে। যারা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসের ওষুধ খাচ্ছেন, তাদের এটি সেবন করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করা খুব কমে যাওয়া) হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ ছাড়া এটি গ্রহণ করা উচিত নয়।
৩. সার্জারির আগে: রক্তে শর্করার উপর এর প্রভাবের কারণে, নির্ধারিত অস্ত্রোপচারের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে হাড়জোড়া সেবন বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৪. অ্যালার্জি: যাদের আঙুর বা এই পরিবারের অন্যান্য উদ্ভিদে অ্যালার্জি আছে, তাদের প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
চাষাবাদ এবং প্রাপ্যতা
হাড়জোড়া একটি অত্যন্ত সহনশীল উদ্ভিদ। এটি খুব কম যত্নেই বেড়ে উঠতে পারে এবং খরা সহ্য করতে পারে।
- চাষাবাদ: এটি সাধারণত কাটিং (কাণ্ডের টুকরো) থেকে সহজেই বংশবিস্তার করে। ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে এমন মাটিতে এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি একটি লতানো উদ্ভিদ হওয়ায়, এটিকে বেড়ে ওঠার জন্য একটি সাপোর্ট (যেমন বেড়া বা খুঁটি) প্রয়োজন হয়।
- প্রাপ্যতা: তাজা হাড়জোড়া গাছ প্রায়শই স্থানীয় নার্সারি বা ভেষজ উদ্ভিদের বাজারে পাওয়া যায়। তবে, সাপ্লিমেন্ট হিসেবে (পাউডার বা ক্যাপসুল) এটি স্বাস্থ্য খাদ্যের দোকান, আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান এবং অনলাইন রিটেইলারদের কাছে ব্যাপকভাবে উপলব্ধ। কেনার সময়, লেবেল পরীক্ষা করে দেখুন যে এটি একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের কিনা এবং এতে সক্রিয় উপাদানের (যেমন কেটোস্টেরন) পরিমাণ উল্লেখ আছে কিনা।
হাড়জোড়া (Cissus quadrangularis) একটি সামান্য লতা থেকে অনেক বেশি কিছু। এর ঐতিহ্যগত খ্যাতি ‘অস্থিসংহারক’ বা হাড় নিরাময়কারী হিসেবে হলেও, আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে এর উপকারিতা আরও অনেক বিস্তৃত। হাড়ের ফ্র্যাকচার নিরাময়কে ত্বরান্বিত করা থেকে শুরু করে ওজন ব্যবস্থাপনা, মেটাবলিক সিন্ড্রোম নিয়ন্ত্রণ এবং জয়েন্টের ব্যথা উপশমে এর শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে।
এর কার্যকারিতার পেছনে রয়েছে কেটোস্টেরন, ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ভিটামিন সি-এর মতো সক্রিয় যৌগগুলির একটি জটিল মিশ্রণ। যদিও এর বেশিরভাগ উপকারিতা শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক গবেষণা (বিশেষত ওজন কমানোর ক্ষেত্রে) দ্বারা সমর্থিত, তবুও এটি কোনো জাদুকরী সমাধান নয়।
যদি আপনি হাড়জোড়াকে আপনার স্বাস্থ্য রুটিনের অংশ করার কথা ভাবেন, তবে একে একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়ামের সহায়ক হিসেবে দেখুন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেকোনো নতুন সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে কথা বলুন, বিশেষ করে যদি আপনার কোনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে বা আপনি অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ করেন। হাড়জোড়া ঐতিহ্য এবং বিজ্ঞানের এক চমৎকার মেলবন্ধন, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।











