দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত লেখিকা হান কাং ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। স্টকহোমে সুইডিশ একাডেমি কর্তৃক এই ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর “তীব্র কাব্যিক গদ্য যা ঐতিহাসিক আঘাতগুলিকে মোকাবেলা করে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে” তার জন্য তিনি এই সম্মানজনক পুরস্কারটি লাভ করেছেন।
৫৩ বছর বয়সী এই লেখিকা তাঁর উপন্যাস “The Vegetarian” এর জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। এই উপন্যাসটি ২০১৬ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে। হান কাং-এর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে “Human Acts”, “The White Book” এবং “Greek Lessons”।
হান কাং ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার গ্বাংজু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি পরিবারের সাথে সিওলে চলে আসেন। ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরীয় সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।
নোবেল পুরস্কার বঞ্চিত ৫টি যুগান্তকারী আবিষ্কার: বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবহেলিত মাইলফলক
১৯৯৩ সালে কবিতা দিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন। পরের বছর “Red Anchor” নামক একটি ছোটগল্প লিখে তিনি উপন্যাস লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্পের সংকলন “Yeosu” প্রকাশিত হয়।
হান কাং-এর লেখায় প্রায়শই ঐতিহাসিক আঘাত, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, পারিবারিক অবহেলা এবং মানব জীবনের নাজুকতার মতো বিষয়গুলি উঠে আসে। তাঁর রচনাগুলি গভীর আবেগপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
“The Vegetarian” উপন্যাসটি একজন তরুণী ইয়ং-হে’র গল্প বলে, যে হিংসাত্মক স্বপ্ন দেখার পর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে তার পারিবারিক জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। উপন্যাসটি তিনটি অংশে বিভক্ত, যার প্রতিটি বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে।
“Human Acts” উপন্যাসটি ১৯৮০ সালের গ্বাংজু গণহত্যার ঘটনা নিয়ে লেখা, যেখানে শত শত বেসামরিক নাগরিক সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল। এই উপন্যাসে হান কাং সহিংসতা ও আঘাতের পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন।
“The White Book” একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেখানে লেখিকা তাঁর বড় বোনের মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করেছেন। এই বইটি ক্ষতি, শোক এবং সময়ের প্রবাহ নিয়ে একটি গভীর অনুধ্যান।
হান কাং-এর লেখার বৈশিষ্ট্য হল তাঁর কাব্যিক শৈলী এবং গদ্যের প্রতি পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বিভিন্ন শৈলীর মধ্যে সীমানা মুছে ফেলেন, যা তাঁর রচনাকে অংশত উপন্যাস, অংশত কবিতার রূপ দেয়। কঠিন বিষয়গুলিকে গভীরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা পাঠকদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
নোবেল কমিটির চেয়ার অ্যান্ডার্স ওলসন মন্তব্য করেছেন যে হান কাং-এর রচনায় “দুর্বল, প্রায়শই নারী জীবনের প্রতি সহানুভূতি” প্রকাশ পায় এবং তিনি “শরীর ও আত্মা, জীবিত ও মৃতের মধ্যে সংযোগের একটি অনন্য সচেতনতা” প্রদর্শন করেন।
হান কাং বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি “Baby Buddha” উপন্যাসের জন্য ২৫তম কোরীয় উপন্যাস পুরস্কার জয় করেন। ২০০০ সালে তিনি কোরিয়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আজকের তরুণ শিল্পী পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে “Mongol Spot” গল্পের জন্য Yi Sang সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১০ সালে “The Wind is Blowing” এর জন্য Dongri সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
২০১৪ সালে “Human Acts” এর জন্য তিনি Manhae সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে “While One Snowflake Melts” উপন্যাসের জন্য Hwang Sun-won সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালে তাঁর “Farewell” উপন্যাসটি Kim Yujung সাহিত্য পুরস্কার জয় করে।
২০১৬ সালে “The Vegetarian” উপন্যাসের জন্য তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এনে দেয়। ২০১৭ সালে ইতালিতে “Human Acts” (Atti umani) উপন্যাসের জন্য Malaparte পুরস্কার পান। ২০১৯ সালে স্পেনে “The Vegetarian” এর জন্য San Clemete পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৯ সালে নরওয়ের Future Library প্রকল্পের পঞ্চম লেখক হিসেবে নির্বাচিত হন হান কাং। তাঁর “Dear Son, My Beloved” রচনাটি ২১১৪ সাল পর্যন্ত ওসলোর Deichman লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত থাকবে।
সর্বশেষ, তাঁর “I Do Not Bid Farewell” উপন্যাসটি ২০২৩ সালে ফ্রান্সে Medicis পুরস্কার এবং ২০২৪ সালে Émile Guimet পুরস্কার লাভ করে।
হান কাং-এর নোবেল পুরস্কার লাভ দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম কোরীয় লেখক এবং সাহিত্যে এই সম্মান পাওয়া প্রথম এশীয় নারী। এর আগে ২০০০ সালে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কিম দাই-জুং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
হান কাং-এর এই সাফল্য শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার নয়, সমগ্র এশিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য একটি বড় অর্জন। তাঁর লেখা বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাওয়ায় কোরীয় সাহিত্যের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই খবরে দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় K-pop গ্রুপ BTS-এর সদস্য RM এবং V উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। RM ইনস্টাগ্রামে একটি কান্নার ইমোজি ও লাল হার্ট দিয়ে এই খবর শেয়ার করেছেন। V লিখেছেন, “লেখক! ছেলেটি আসছে। আমি সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন এটি পড়েছি। অভিনন্দন।” V-এর পোস্টটি হান কাং-এর “Human Acts” (কোরীয় শিরোনামে “The Boy is Coming”) উপন্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে, যা তিনি সম্প্রতি সামরিক সেবাকালীন পড়েছেন।
হান কাং-এর এই অর্জন শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ কোরীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। তাঁর লেখা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ায় কোরীয় সাহিত্যের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।