হনুমান আর পঞ্চমুখী হনুমানের মধ্যে রহস্যময় পার্থক্যের সম্পূর্ণ গাইড!

হিন্দু ধর্মে হনুমান এবং পঞ্চমুখী হনুমানের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে অনেকেই কৌতূহলী। হনুমান হলেন মহাবীর রামভক্ত দেবতা যিনি তাঁর অসীম ভক্তি এবং অলৌকিক শক্তির জন্য পরিচিত। কিন্তু পঞ্চমুখী হনুমান বলতে বোঝায়…

মনীষা মুখার্জী

 

হিন্দু ধর্মে হনুমান এবং পঞ্চমুখী হনুমানের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে অনেকেই কৌতূহলী। হনুমান হলেন মহাবীর রামভক্ত দেবতা যিনি তাঁর অসীম ভক্তি এবং অলৌকিক শক্তির জন্য পরিচিত। কিন্তু পঞ্চমুখী হনুমান বলতে বোঝায় হনুমানের এক বিশেষ রূপ, যা তিনি রাম-লক্ষ্মণকে উদ্ধার করতে পাতাল লোকে ধারণ করেছিলেন। এই দুই রূপের মধ্যে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক ও পৌরাণিক তাৎপর্য, যার বিস্তারিত জানা প্রয়োজন প্রতিটি ভক্তের কাছে।

আজকের এই বিশদ আলোচনায় আমরা হনুমান এবং পঞ্চমুখী হনুমানের সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত জানব – তাঁদের রূপ, শক্তি, পূজা বিধি এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে।

হনুমানের সাধারণ রূপ ও বৈশিষ্ট্য

হনুমান হলেন বায়ু দেবতার আধ্যাত্মিক পুত্র এবং মা অঞ্জনার সন্তান। তিনি ভগবান শিবের একাদশ অবতার এবং একই সাথে ত্রেতাযুগে ভগবান রামের সেবার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন।

হনুমানের সাধারণ রূপে থাকে:

  • একটি মুখ

  • দুটি হাত

  • অসীম শক্তি ও গদা ধারণ

  • কৃষ্ণবর্ণ বা কমলা বর্ণের দেহ

হনুমানের সাধারণ রূপেই রয়েছে অষ্ট সিদ্ধি – অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, বশিত্ব এবং ইশিত্ব সিদ্ধি। এই সিদ্ধিগুলোর বলে তিনি তার দেহকে অণুর চেয়েও ছোট করতে পারেন, পর্বত আকার ধারণ করতে পারেন, এবং অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেন।

পঞ্চমুখী হনুমানের উৎপত্তি ও কাহিনী

পঞ্চমুখী হনুমানের রূপ ধারণের পিছনে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর পৌরাণিক কাহিনী। রামায়ণের বিশেষ অংশে, যখন রাবণ তার পরাজয় আসন্ন দেখে, তখন সে তার ভাই অহিরাবণকে সাহায্যের জন্য ডাকে।

অহিরাবণের কূটকৌশল:

অহিরাবণ ছিল পাতাল লোকের রাজা এবং মা পাতাল ভৈরবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। সে বিভীষণের রূপ ধারণ করে রাম শিবিরে প্রবেশ করে এবং মায়াবলে রাম-লক্ষ্মণকে অচেতন করে নিয়ে যায় পাতাল লোকে।

পাতাল লোকে হনুমানের অভিযান:

রাম-লক্ষ্মণের অনুপস্থিতি টের পেয়ে হনুমান পাতাল লোকে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান অহিরাবণ পাঁচটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবী পাতাল ভৈরবীর পূজা করছে এবং রাম-লক্ষ্মণকে বলি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পঞ্চমুখী রূপ ধারণ:

হনুমান বুঝতে পারেন যে এই পাঁচটি প্রদীপ একসাথে নিভাতে পারলেই অহিরাবণকে পরাজিত করা সম্ভব। তাই তিনি তার পঞ্চমুখী রূপ ধারণ করেন এবং একসাথে পাঁচটি প্রদীপ নিভিয়ে দেন।

পঞ্চমুখী হনুমানের পাঁচটি মুখের বিস্তারিত বর্ণনা

পঞ্চমুখী হনুমানের পাঁচটি মুখের প্রতিটির নিজস্ব তাৎপর্য এবং শক্তি রয়েছে:

১. পূর্বমুখী – হনুমান মুখ

  • অবস্থান: পূর্ব দিকে মুখ করে

  • তাৎপর্য: সাহস, শক্তি এবং ভক্তির প্রতীক

  • গুণাবলি: সমস্ত পাপের দাগ দূর করে, মনের বিশুদ্ধতা দেয় এবং শত্রুদের বশ করে

  • প্রভাব: ভক্তদের শত্রুদের উপর বিজয় প্রদান করে

২. দক্ষিণমুখী – নরসিংহ মুখ

  • অবস্থান: দক্ষিণ দিকে মুখ করে

  • তাৎপর্য: নির্ভীকতা এবং ভয় নাশের প্রতীক

  • গুণাবলি: তীক্ষ্ণ দাঁত এবং বাঁকা ভ্রূ সহ ভয়ঙ্কর রূপ

  • প্রভাব: সাধককে সমস্ত ভয় থেকে মুক্তি দেয় এবং দুষ্ট শক্তি ধ্বংস করে

৩. পশ্চিমমুখী – গরুড় মুখ

  • অবস্থান: পশ্চিম দিকে মুখ করে

  • তাৎপর্য: সর্প ভয় এবং বিষক্রিয়া নাশের প্রতীক

  • গুণাবলি: বাঁকা থুতনি সহ শক্তিশালী গরুড় রূপ

  • প্রভাব: সমস্ত বাধা দূর করে এবং সৌভাগ্যের প্রতীক

৪. উত্তরমুখী – বরাহ মুখ

  • অবস্থান: উত্তর দিকে মুখ করে

  • তাৎপর্য: ধন-সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক

  • গুণাবলি: কালো বর্ণের কিন্তু উজ্জ্বল ন্যায় আকাশের মতো

  • প্রভাব: ভূত-প্রেত দূর করে, সুখ-সমৃদ্ধি দেয় এবং দীর্ঘায়ু প্রদান করে

৫. ঊর্ধ্বমুখী – হয়গ্রীব মুখ

  • অবস্থান: আকাশের দিকে মুখ করে

  • তাৎপর্য: জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক

  • গুণাবলি: অশ্ব বা ঘোড়ার মুখ

  • প্রভাব: শক্তি ও প্রজ্ঞা প্রদান করে এবং গুপ্ত ইচ্ছা পূরণ করে

হনুমান ও পঞ্চমুখী হনুমানের মূল পার্থক্য

শারীরিক গঠনগত পার্থক্য

সাধারণ হনুমান:

  • একটি মুখ

  • দুটি হাত

  • একটি মূর্তিতে সমস্ত গুণাবলি

পঞ্চমুখী হনুমান:

  • পাঁচটি মুখ পাঁচটি ভিন্ন দিকে

  • দশটি হাত

  • পনেরটি নেত্র (প্রতিটি মুখে তিনটি করে)

আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের পার্থক্য

সাধারণ হনুমানের তাৎপর্য:

  • রাম ভক্তি ও আনুগত্যের প্রতীক

  • শক্তি, সাহস ও নিঃস্বার্থ সেবার আদর্শ

  • বায়ু দেবতার অবতার রূপে প্রাণশক্তির নিয়ন্ত্রক

পঞ্চমুখী হনুমানের তাৎপর্য:

  • পঞ্চ তত্ত্বের (পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ) নিয়ন্ত্রক

  • পাঁচ দিকের (পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব) রক্ষাকর্তা

  • বিষ্ণুর চার অবতার + শিবের রুদ্র অবতারের সমন্বয়

পূজা পদ্ধতির পার্থক্য

সাধারণ হনুমানের পূজা:

  • হনুমান চালিশা পাঠ

  • মঙ্গলবার বিশেষ পূজা

  • সিঁদুর, তুলসী পাতা, লাড্ডু নিবেদন

  • গদা ও বজরং বলীর মন্ত্র জপ

পঞ্চমুখী হনুমানের পূজা:

  • বিশেষ পঞ্চমুখী মন্ত্র জপ

  • পাঁচটি বিভিন্ন দিকে পাঁচটি প্রদীপ জ্বালানো

  • পাঁচটি ভিন্ন রঙের ফুল অর্পণ

  • বিশেষ কবচ পাঠ

পঞ্চমুখী হনুমানের পূজা বিধি ও নিয়মাবলি

পূজার উপযুক্ত সময়

  • বিশেষত মঙ্গলবারে পূজা করা শ্রেয়

  • হনুমান জয়ন্তীর দিনে বিশেষ পূজা

  • সংকট ও বিপদের সময় পূজা অধিক ফলপ্রসূ

পূজার প্রয়োজনীয় সামগ্রী

  • পঞ্চমুখী হনুমানের ছবি বা মূর্তি

  • পাঁচটি প্রদীপ পাঁচ দিকে স্থাপনের জন্য

  • লাল কাপড়, সিঁদুর, চন্দন

  • পাঁচ রঙের ফুল (সাদা, লাল, হলুদ, গোলাপি, কমলা)

  • প্রসাদ হিসেবে লাড্ডু, কলা

পূজার সঠিক পদ্ধতি

প্রথম ধাপ: পূজার স্থানে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে পবিত্র করুন
দ্বিতীয় ধাপ: পঞ্চমুখী হনুমানের মূর্তি বা ছবি স্থাপন করুন
তৃতীয় ধাপ: পাঁচ দিকে পাঁচটি প্রদীপ জ্বালান
চতুর্থ ধাপ: প্রতিটি মুখের উদ্দেশ্যে আলাদা নিবেদন করুন
পঞ্চম ধাপ: পঞ্চমুখী হনুমান মন্ত্র জপ করুন

গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চমুখী হনুমান মন্ত্র

সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র হল: “ওঁ নমো হনুমতে রুদ্রাবতারায় সর্ব শত্রু সংহারনায় স্বাহা”

এছাড়াও রয়েছে বিশেষ শত্রু নাশক মন্ত্র যা ১০৮ বার জপ করতে হয়।

পঞ্চমুখী হনুমানের বাস্তু শাস্ত্রীয় গুরুত্ব

বাড়িতে স্থাপনের সঠিক দিক

প্রধান প্রবেশদ্বার: অশুভ শক্তির প্রবেশ রোধ করতে
দক্ষিণ দিক: নেতিবাচক শক্তি দূর করার জন্য
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ: বাস্তু দোষ নিবারণের জন্য

পঞ্চমুখী হনুমানের বিশেষ উপকারিতা

  • সকল দিক থেকে সুরক্ষা প্রদান

  • ভূত-প্রেত, কালাজাদু থেকে রক্ষা

  • শত্রু বাধা দূরীকরণ

  • আর্থিক সমৃদ্ধি ও মানসিক শান্তি

  • পারিবারিক কলহ নিবারণ

আধুনিক যুগে হনুমান ও পঞ্চমুখী হনুমানের প্রাসঙ্গিকতা

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি

আজকের চাপের যুগে হনুমানের ভক্তি মানসিক শান্তি এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি প্রদান করে। বিশেষত পঞ্চমুখী হনুমানের ধ্যান পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

আধ্যাত্মিক বিকাশ

পঞ্চমুখী হনুমানের প্রতিটি মুখ আধ্যাত্মিক বিকাশের একটি দিককে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এই রূপের উপাসনা সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক।

সামাজিক সম্প্রীতি

হনুমানের নিঃস্বার্থ সেবা এবং পঞ্চমুখী রূপের সর্বজনীন রক্ষার ভাবনা আধুনিক সমাজে সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে অনুপ্রেরণা দেয়।

হনুমান এবং পঞ্চমুখী হনুমানের মধ্যে পার্থক্য কেবল শারীরিক গঠনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর গভীর আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। সাধারণ হনুমান যেখানে ভক্তি, শক্তি এবং সেবার আদর্শ স্থাপন করেন, সেখানে পঞ্চমুখী হনুমান পঞ্চ তত্ত্ব ও পঞ্চ দিকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী রূপে প্রতিষ্ঠিত। উভয় রূপেরই নিজস্ব গুরুত্ব ও উপাসনা পদ্ধতি রয়েছে, যা ভক্তদের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।

আধুনিক যুগে এই দুই রূপের উপাসনা আমাদের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি এনে দিতে পারে। তাই প্রতিটি ভক্তের উচিত নিজের প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী এই মহান দেবতার যথাযথ পূজা ও ধ্যান করা।

About Author
মনীষা মুখার্জী