আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় ভাত একটি প্রধান উপাদান। ভাত রান্না করার সময় যে সাদা তরল পদার্থটি তৈরি হয়, সেটিই ভাতের মাড় বা ফ্যান। অনেকেই এই ভাতের মাড়কে স্বাস্থ্যকর মনে করে নিয়মিত পান করেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিক রয়েছে যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে? আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা জানব ভাতের মাড়ের লুকিয়ে থাকা সেই সব ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে, যা জানলে আপনি চমকে উঠবেন!
ভাতের মাড় কী এবং কেন এটি জনপ্রিয়?
ভাতের মাড় হল চাল সেদ্ধ করার সময় তৈরি হওয়া সাদাটে তরল পদার্থ। এতে স্টার্চ, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থ থাকে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী পানীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেকে মনে করেন এটি শক্তি বৃদ্ধি করে এবং পেটের সমস্যা সমাধান করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে অতিরিক্ত সেবনে ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিক প্রকাশ পায়।
ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিকসমূহ: যা আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে
১. দ্রুত ওজন বৃদ্ধির কারণ
ভাতের মাড়ে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট এবং ক্যালরি থাকে। নিয়মিত এবং অতিরিক্ত পরিমাণে ভাতের মাড় সেবন করলে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দিনে ২-৩ গ্লাসের বেশি ভাতের মাড় খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত সেবনের ফলে শরীরে অপ্রয়োজনীয় চর্বি জমা হয় এবং স্থূলতার সমস্যা দেখা দেয়।
২. হজমশক্তি ব্যাহত হওয়া
ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে হজমের সমস্যা অন্যতম। অতিরিক্ত ভাতের মাড় পাচনতন্ত্রে জমা হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা এবং পেটে ব্যথার সৃষ্টি করে। এর তরল প্রকৃতির কারণে বেশি পরিমাণে সেবন করলে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানার সমস্যা হতে পারে।
৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
ভাতের মাড়ে উচ্চমাত্রার শর্করা থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বিপজ্জনক হতে পারে। নিয়মিত সেবনের ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। এমনকি সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি সেবনে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
৪. রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা
অতিরিক্ত ভাতের মাড় সেবনে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে থাকা অতিরিক্ত সোডিয়াম এবং কার্বোহাইড্রেট রক্তচাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ফলে হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
৫. কোলেস্টেরল বৃদ্ধি
ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়মিত সেবনে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে হার্টের রক্তনালীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব
ভাতের মাড়ে থাকা স্টার্চ দাঁতে লেগে থাকে এবং মুখের ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য হিসেবে কাজ করে। এর ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দাঁত ক্ষয় হয়ে যায় এবং দাঁতে পোকা লাগার সম্ভাবনা বাড়ে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে দাঁত ঝরে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
অতিরিক্ত ঘুম ও শারীরিক অলসতা
ভাতের মাড়ে সামান্য পরিমাণ প্রাকৃতিক অ্যালকোহল থাকে। নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমাণে সেবন করলে অতিরিক্ত ঘুম পায় এবং শারীরিক অলসতা দেখা দেয়। এর ফলে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
বিশেষ সতর্কতা: কাদের এড়িয়ে চলা উচিত?
গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকি
যদিও গর্ভাবস্থায় ভাতের মাড়ের কিছু উপকারিতা রয়েছে, তবুও অতিরিক্ত সেবন ক্ষতিকর। ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিক গর্ভবতী নারী ও গর্ভের শিশুর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে সাবধানতা
ছোট শিশুদের হজমশক্তি দুর্বল থাকায় ভাতের মাড় তাদের পেটে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের ভাতের মাড় না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
সঠিক ব্যবহারের নির্দেশনা
ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিক এড়াতে হলে পরিমিত ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দিনে সর্বোচ্চ ২-৩ গ্লাস ভাতের মাড় সেবন করতে পারেন। তবে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
পুষ্টিবিদরা জানাচ্ছেন, যেকোনো খাবারেরই অতিরিক্ত সেবন ক্ষতিকর। ভাতের মাড়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের গবেষণা অনুযায়ী, ভাতের মাড়ে স্টার্চের পরিমাণ বেশি থাকায় অতিরিক্ত সেবন বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
সাদা চাল বনাম লাল চালের মাড়
লাল চালের মাড় তুলনামূলকভাবে বেশি পুষ্টিকর এবং কম ক্ষতিকর। সাদা চালের মাড়ে মেটাবলিজম ও কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে, যা ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিক আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই সম্ভব হলে লাল চালের মাড় বেছে নেওয়া ভালো।
আমাদের এই বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, ভাতের মাড়ের যেমন উপকারিতা রয়েছে, তেমনি ভাতের মাড়ের ক্ষতিকর দিকও কম নয়। অতিরিক্ত সেবন থেকে বিরত থেকে পরিমিত ব্যবহার করলে এর ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো সম্ভব। স্বাস্থ্য সচেতনতার সাথে যেকোনো খাবার গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আজই ভাতের মাড় সেবনে সংযম আনুন।