ডালিম খেলে কি হয়? চমকপ্রদ ১২টি স্বাস্থ্য উপকারিতা যা আপনি জানেন না!

ডালিম (Punica granatum) একটি প্রাচীন এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল যা হাজার বছর ধরে ঔষধি গুণাগুণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে । বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ডালিম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে,…

Debolina Roy

 

ডালিম (Punica granatum) একটি প্রাচীন এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল যা হাজার বছর ধরে ঔষধি গুণাগুণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে । বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ডালিম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় । একটি মাঝারি আকারের ডালিমে (প্রায় ২৮২ গ্রাম) মাত্র ২৩৪ ক্যালোরি রয়েছে, কিন্তু এতে ১১.৩ গ্রাম ফাইবার, ৩২% দৈনিক ভিটামিন সি এবং ২৭% ফোলেট পাওয়া যায় । আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ডালিমকে একটি “সুপারফুড” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কারণ এতে পলিফেনল, পিউনিক্যালাজিন এবং ইলাজিক অ্যাসিডের মতো শক্তিশালী বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান রয়েছে যা একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করে ।

​ডালিমের পুষ্টিগুণ

মাইক্রো এবং ম্যাক্রো পুষ্টি উপাদান

একটি সম্পূর্ণ ডালিমে (প্রায় ২৮২ গ্রাম) যে পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় তা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং স্বাস্থ্যকর । এতে ২৩৪ ক্যালোরি, ৪.৭ গ্রাম প্রোটিন, ৫২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং মাত্র ৩.৩ গ্রাম ফ্যাট রয়েছে । ফাইবার সামগ্রী ১১.৩ গ্রাম, যা দৈনিক চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করে এবং হজমস্বাস্থ্য উন্নত করে ।

​ডালিমে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে ৬৬৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৩৩.৮ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, এবং ৩৬ মিলিগ্রাম ফসফরাস । ভিটামিনের ক্ষেত্রে, ডালিম ভিটামিন সি-এর একটি চমৎকার উৎস (২৮.৮ মিলিগ্রাম), পাশাপাশি ভিটামিন কে (৪৬.২ মাইক্রোগ্রাম) এবং ফোলেট (১০৭.২ মাইক্রোগ্রাম) রয়েছে ।

​অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধি

ডালিমের রসে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ রেড ওয়াইন এবং গ্রিন টি-এর চেয়েও বেশি, যা মূলত এলাজিট্যানিন এবং হাইড্রোসেবল ট্যানিন থেকে আসে । এই শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ফ্রি র‍্যাডিক্যাল নিষ্ক্রিয় করে এবং কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে পিউনিক্যালাজিন এবং ইলাজিক অ্যাসিড ধারাবাহিতভাবে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং NF-κB সিগন্যালিং মডিউলেট করে ।

​ডালিম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা

হৃদরোগ প্রতিরোধ

ডালিম হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ উপকারী একটি ফল। ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে যে ক্যারোটিড ধমনীতে এথেরোস্ক্লেরোসিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ডালিমের রস এক বছর পর এথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাক ৩৫% পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে । যারা ডালিম খাননি তাদের ক্ষেত্রে এথেরোস্ক্লেরোসিস ৯% বৃদ্ধি পেয়েছিল ।

​প্রাণী গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ডালিম এক্সট্র্যাক্ট এন্ডোথেলিয়াল ডিসফাংশন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম এবং এথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাকের অগ্রগতি প্রতিরোধ ও বিপরীত করতে পারে । একটি ইঁদুর গবেষণায়, ডালিম এথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাকের আকার ৪৪% কমিয়েছে । এছাড়াও, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যায়াম-প্রেরিত ইস্কেমিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে ।

​রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ

ডালিম উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী কারণ এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং রক্তচাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে । ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে যে ডালিম ভাস্কুলার প্যারামিটার, রক্তচাপ এবং এন্ডোথেলিয়াল ফাংশন উন্নত করে ।

​তবে, যারা ইতিমধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন করছেন তাদের অতিরিক্ত ডালিম খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত কারণ এটি রক্তচাপ আরও কমিয়ে দিতে পারে । চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া নিরাপদ ।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডালিম একটি চমৎকার খাবার কারণ এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স তুলনামূলকভাবে কম, সাধারণত ৩৫ এর কাছাকাছি, যার অর্থ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে এবং স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি করে । একটি ব্যাপক মেটা-অ্যানালাইসিস প্রকাশ করেছে যে ডালিম খাওয়ার ফলে ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ (FBG) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় (WMD: −2.29 mg/dL) ।

একই গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিম সেবনে ফাস্টিং ইনসুলিন (WMD: −1.06 µU/ml), হিমোগ্লোবিন A1c (WMD: −0.13%) এবং HOMA-IR (WMD: −0.30) উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় । ডালিমের পলিফেনল অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলিকে রক্ষা করে, ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ায় এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী ।

ক্যান্সার প্রতিরোধ

ডালিমের অ্যান্টিক্যান্সার বৈশিষ্ট্য একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিম এক্সট্র্যাক্ট বিশেষভাবে স্তন, প্রোস্টেট, কোলন এবং ফুসফুসের ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে । পলিফেনলিক ফ্র্যাকশন স্তন ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে অ্যারোমেটেজ এবং ১৭-β-হাইড্রোক্সিস্টেরয়েড ডিহাইড্রোজেনেজ টাইপ ১ কার্যকলাপ ৬০-৮০% প্রতিরোধ করে ।

প্রোস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, ডালিমের তেল, ফার্মেন্টেড রস পলিফেনল এবং পেরিকার্প পলিফেনল মানব প্রোস্টেট ক্যান্সার LNCaP, PC-3 এবং DU 145 কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করেছে, যখন স্বাভাবিক প্রোস্টেট এপিথেলিয়াল কোষগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে কম প্রভাবিত হয়েছে । ডালিম বীজের তেল (PGO; 100 µg/ml) MCF-7 কোষের বৃদ্ধি ৯০% প্রতিরোধ করেছে ।

প্রদাহ বিরোধী প্রভাব

ডালিমের শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এলাজিট্যানিন কিছু প্রদাহজনক মার্কারের প্রমোটর ইনহিবিশন এবং তাদের উৎপাদন ব্লক করে । দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ডায়াবেটিস এবং এর জটিলতার অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ।

ডালিমের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি যৌগ এই প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে । গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পিউনিক্যালাজিন, ইলাজিক অ্যাসিড এবং অ্যান্থোসায়ানিন ধারাবাহিতভাবে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং NF-κB সিগন্যালিং মডিউলেট করে ।

ওজন নিয়ন্ত্রণ

স্থূলতা ব্যবস্থাপনায় ডালিমের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি মেটা-অ্যানালাইসিস যাতে ২৮টি ট্রায়াল অন্তর্ভুক্ত ছিল তাতে দেখা গেছে যে ডালিম সেবনে শরীরের ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় (WMD: −1.97, 95% CI: −2.91, −1.03, p < .05) । একই গবেষণায় BMI-তেও উল্লেখযোগ্য হ্রাস পাওয়া গেছে (WMD: −0.48, 95% CI: −0.76, −0.20, p < .05) ।

​ডালিম ক্যালোরিতে কম কিন্তু ফাইবারে উচ্চ, যা তৃপ্তি এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে । একটি সুস্থ ওজন বজায় রাখা ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যাবশ্যক এবং ডালিম এই লক্ষ্য অর্জনে একটি প্রাকৃতিক সহায়ক।

ব্যায়াম কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি

ক্রীড়াবিদ এবং ব্যায়াম উৎসাহীদের জন্য ডালিম একটি প্রতিশ্রুতিশীল সাপ্লিমেন্ট। গবেষণা পরামর্শ দেয় যে ডালিম পেশী পুনরুদ্ধার, ব্যথা এবং ব্যায়াম কর্মক্ষমতা উন্নত করতে পারে । এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য ব্যায়াম-প্রেরিত অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে ।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ডালিম ব্যায়াম সহনশীলতা বাড়ায় এবং পেশীর ক্লান্তি কমায় । এটি অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স উন্নত করার জন্য একটি প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ উপায় ।

মূত্রনালীর স্বাস্থ্য

ডালিম মূত্রনালীর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী কারণ এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিম রস কিডনির পাথর গঠনের ঝুঁকি কমাতে পারে।

তবে, গবেষণায় কিছু রোগীর ক্ষেত্রে মূত্রনালীর সমস্যা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে, তাই পরিমিত সেবন গুরুত্বপূর্ণ । অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্যা অতিরিক্ত সেবনের ফলে হয়ে থাকে ।

মস্তিষ্ক স্বাস্থ্য

ডালিমের নিউরোপ্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নির্বাচিত জ্ঞানীয় ফলাফলের উন্নতি দেখা গেছে । ডালিমের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের কোষগুলিকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিম-উৎপন্ন পণ্য বার্ধক্যজনিত কার্যকরী পতন হ্রাস করে এবং রিডক্স ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে । এটি আলঝেইমার এবং পার্কিনসন রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

ত্বক স্বাস্থ্য

ডালিমে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ভিটামিন সি কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা ত্বককে দৃঢ় এবং তরুণ রাখে । অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের কোষগুলিকে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্যের লক্ষণ কমায়।

ডালিমের বীজের তেল ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং রোদে পোড়া এবং প্রদাহ থেকে সুরক্ষা দেয়। নিয়মিত ডালিম খেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং ব্রণ কমে।

হাড়ের স্বাস্থ্য

ডালিমে থাকা ভিটামিন কে এবং খনিজ উপাদান হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন কে ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিমের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য অস্টিওআর্থারাইটিসের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

​ডালিমে থাকা ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের গঠন এবং শক্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে । বয়স্কদের জন্য নিয়মিত ডালিম খাওয়া হাড়ের ক্ষয় রোধে উপকারী।

পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য

ডালিমে উচ্চ মাত্রার ফাইবার রয়েছে যা পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক। প্রতিটি ডালিমে ১১.৩ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা দৈনিক চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করে । ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং পাচন প্রক্রিয়া মসৃণ রাখে।

ডালিমের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য পাচনতন্ত্রের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং গাট হেলথ উন্নত করে। এটি উপকারী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং পেটের স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

ডালিমে থাকা ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। একটি মাঝারি ডালিমে দৈনিক ভিটামিন সি চাহিদার ৩২% পাওয়া যায় । ভিটামিন সি শ্বেত রক্ত কণিকা উৎপাদন বাড়ায় এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।

ডালিমের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য শরীরকে বিভিন্ন রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত ডালিম খেলে সাধারণ সর্দি-কাশি এবং ফ্লু-এর ঝুঁকি কমে এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়।

ডালিম খাওয়ার সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া

কিছু ব্যক্তির ডালিমে অ্যালার্জি থাকতে পারে। অ্যালার্জির লক্ষণগুলির মধ্যে গলায় চুলকানি, পেটের অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট, ফোলাভাব বা গলা ব্যথা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে । আরও গুরুতর ক্ষেত্রে, অ্যালার্জি শ্বাসকষ্ট বা ফুসকুড়ির কারণ হতে পারে ।

কেস রিপোর্ট স্টাডিতে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট করা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া । ডালিম খাওয়ার পর যদি এই লক্ষণগুলি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া উচিত ।

পাচনতন্ত্রের সমস্যা

ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে সবচেয়ে সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । অতিরিক্ত ডালিম খেলে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া বা বমি বমি ভাব হতে পারে। এটি মূলত ডালিমে উচ্চ ফাইবার এবং ট্যানিন সামগ্রীর কারণে হয়।

একটি সিস্টেমেটিক রিভিউতে ৬৬টি ক্লিনিক্যাল আর্টিকেল অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে ১১টি আর্টিকেল ডালিমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রিপোর্ট করেছে । পরিমিত পরিমাণে সেবন করলে এই সমস্যাগুলি এড়ানো সম্ভব।

রক্তচাপ হ্রাস

ডালিম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, যা সাধারণত একটি উপকারিতা । তবে, যারা ইতিমধ্যে রক্তচাপের ওষুধ সেবন করছেন বা যাদের নিম্ন রক্তচাপ রয়েছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত ডালিম খাওয়া সমস্যা হতে পারে ।

রক্তচাপ অতিরিক্ত কমে গেলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা এবং অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রক্তচাপের ওষুধ সেবনকারীদের ডালিম খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।

মূত্রনালীর সমস্যা

গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ফ্লু-এর মতো লক্ষণ এবং মূত্রনালীর সমস্যা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে । এই সমস্যাগুলি সাধারণত হালকা এবং অস্থায়ী হয়। পর্যাপ্ত পানি পান করলে এবং পরিমিত পরিমাণে ডালিম খেলে এই সমস্যা এড়ানো যায়।

সামগ্রিকভাবে, রিপোর্ট করা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী ডালিম এবং এর এক্সট্র্যাক্ট নিরাপদ বলে মনে হয় । তবে, ডালিম পণ্য নিয়ে আরও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রিত ট্রায়াল পরিচালনা এবং যেকোনো সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন ।

সকালে খালি পেটে লিকার চা: অ্যাসিডিটির ঝুঁকি কতটা? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

ডালিম খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি

তাজা ডালিম খাওয়া

তাজা ডালিমের বীজ (arils) খাওয়া সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়। বীজগুলি সরাসরি খাওয়া যায় অথবা সালাদ, দই, বা ওটমিলে যোগ করা যায়। তাজা ডালিমে সম্পূর্ণ ফাইবার এবং পুষ্টি উপাদান থাকে, যা রস থেকে বেশি উপকারী ।

একটি মাঝারি আকারের ডালিম খাওয়া দৈনিক ফল গ্রহণের একটি ভাল অংশ পূরণ করে। নাস্তা বা খাবারের পরে ডালিম খেলে পুষ্টি শোষণ ভাল হয়। বীজের সাথে সাদা অংশ (pith) খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত কারণ এটি তিক্ত স্বাদের।

ডালিমের রস

ডালিমের রস একটি জনপ্রিয় পানীয়, তবে এতে ফাইবার এবং কিছু পুষ্টি উপাদান কম থাকে । তাজা ডালিমের রস তৈরি করলে সর্বাধিক পুষ্টি পাওয়া যায়। বাজারে কেনা রসে প্রায়ই চিনি যুক্ত থাকে, তাই লেবেল পড়ে ১০০% খাঁটি ডালিমের রস নির্বাচন করা উচিত।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পুরো ডালিম খাওয়া রসের চেয়ে ভাল কারণ ফাইবার রক্তে শর্করার শোষণ ধীর করে । দিনে এক গ্লাস (প্রায় ২৫০ মিলি) ডালিমের রস পরিমিত এবং নিরাপদ।

ডালিমের বীজের তেল

ডালিমের বীজের তেল ত্বকের যত্নে এবং স্বাস্থ্য সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ যা প্রদাহ কমায় এবং কোষের স্বাস্থ্য উন্নত করে । তেল সরাসরি ত্বকে প্রয়োগ করা যায় অথবা ক্যাপসুল আকারে সেবন করা যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে ডালিম বীজের তেল (100 µg/ml) MCF-7 কোষের বৃদ্ধি ৯০% প্রতিরোধ করে । তবে, কনসেন্ট্রেটেড পণ্য ব্যবহার করার সময় নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসরণ করা এবং ওষুধ সেবনকারীদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।

সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্টের ভবিষ্যৎ: AI কি মানুষের বিকল্প হবে? জানুন সত্যিটা

বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দেশিকা

গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলা

গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলারা পরিমিত পরিমাণে ডালিম খেতে পারেন। ডালিমে থাকা ফোলেট গর্ভাবস্থায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ভ্রূণের স্নায়ু নল ত্রুটি প্রতিরোধে সাহায্য করে । একটি ডালিমে দৈনিক ফোলেট চাহিদার ২৭% পাওয়া যায় ।

তবে, গর্ভবতী মহিলাদের কনসেন্ট্রেটেড ডালিম এক্সট্র্যাক্ট বা সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলা উচিত যদি না চিকিৎসক পরামর্শ দেন। তাজা ডালিম খাওয়া নিরাপদ এবং পুষ্টিকর। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং আয়রন শোষণে সহায়তা করে, যা গর্ভাবস্থায় উপকারী।

শিশুদের জন্য

শিশুরা ছয় মাস বয়সের পর থেকে ডালিম খেতে পারে। ডালিমের রস পানির সাথে মিশিয়ে দিলে শিশুদের জন্য সহজে হজম হয়। তবে, বীজ গলায় আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাই ছোট শিশুদের তত্ত্বাবধানে খাওয়ানো উচিত।

ডালিমে থাকা ভিটামিন এবং খনিজ শিশুদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে সহায়তা করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। প্রথমবার খাওয়ানোর সময় অল্প পরিমাণে দিয়ে শুরু করা উচিত এবং অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

বয়স্কদের জন্য

বয়স্কদের জন্য ডালিম বিশেষভাবে উপকারী কারণ এটি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। হৃদরোগ, হাড়ের ক্ষয়, এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমাতে ডালিম কার্যকর । এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে এবং দীর্ঘায়ু বৃদ্ধি করতে পারে।

তবে, যারা একাধিক ওষুধ সেবন করছেন তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত কারণ ডালিম কিছু ওষুধের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে। বিশেষত রক্ত পাতলা করার ওষুধ এবং রক্তচাপের ওষুধের সাথে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত খাওয়া সবচেয়ে উপকারী।

পরিসংখ্যান এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ

পুষ্টি উপাদান প্রতি ১০০ গ্রাম
প্রতি সম্পূর্ণ ডালিম (২৮২ গ্রাম)
দৈনিক চাহিদার %
ক্যালোরি ৮৩ ২৩৪
প্রোটিন ২ গ্রাম ৪.৭ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট ১৯ গ্রাম ৫২ গ্রাম
ফাইবার ৪ গ্রাম ১১.৩ গ্রাম ৪৫%
ভিটামিন সি ১০ মিলিগ্রাম ২৮.৮ মিলিগ্রাম ৩২%
ফোলেট ৩৮ মাইক্রোগ্রাম ১০৭.২ মাইক্রোগ্রাম ২৭%
পটাশিয়াম ২৩৬ মিলিগ্রাম ৬৬৬ মিলিগ্রাম ১৩%
ম্যাগনেসিয়াম ১২ মিলিগ্রাম ৩৩.৮ মিলিগ্রাম ৮%

গবেষণা ভিত্তিক ফলাফল

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলো নিম্নরূপ:

ওজন হ্রাস: ২৮টি ট্রায়ালের পুলড অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে যে ডালিম সেবনে শরীরের ওজন ১.৯৭ কেজি এবং BMI ০.৪৮ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় ।

রক্তে শর্করা: ডালিম খাওয়ার ফলে ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ ২.২৯ mg/dL, ফাস্টিং ইনসুলিন ১.০৬ µU/ml, হিমোগ্লোবিন A1c ০.১৩% এবং HOMA-IR ০.৩০ কমে যায় ।

হৃদরোগ: ক্যারোটিড ধমনীতে এথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাক ৩৫% কমে যায় এক বছর ডালিমের রস খাওয়ার পর, যখন নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে ৯% বৃদ্ধি পায় ।

ক্যান্সার: ডালিম বীজের তেল MCF-7 কোষের বৃদ্ধি ৯০% প্রতিরোধ করে এবং MDA-MB-435 কোষে ৫৪% অ্যাপোপটোসিস প্ররোচিত করে ।

নিরাপত্তা: ৬৬টি ক্লিনিক্যাল আর্টিকেলের মধ্যে মাত্র ১১টিতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রিপোর্ট করা হয়েছে, যা ডালিমের উচ্চ নিরাপত্তা প্রোফাইল নির্দেশ করে ।

ডালিম একটি অসাধারণ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফল যা হাজার বছর ধরে স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য মূল্যবান । আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে ডালিম খেলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এবং প্রদাহজনিত রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে । এতে থাকা পিউনিক্যালাজিন, ইলাজিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য পলিফেনল শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য প্রদান করে যা একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করে । যদিও ডালিম সাধারণত নিরাপদ এবং সুস্বাদু, তবে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া এবং বিশেষ স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ । নিয়মিত ডালিম খাওয়া একটি সুস্থ জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে অত্যন্ত উপকারী এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। ডালিমকে আপনার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে আপনি প্রাকৃতিকভাবে আপনার স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারেন এবং বিভিন্ন জীবনযাত্রাজনিত রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে পারেন।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

আরও পড়ুন