আপনি কি জানেন যে হার্টের রোগীদের কোন পাশ ফিরে ঘুমানো উচিত তা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে? প্রতিদিন রাতে আমরা যে ভঙ্গিতে ঘুমাই, সেটি আমাদের হৃদযন্ত্রের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ঘুমের ভঙ্গি নির্বাচন করা হয়ে উঠতে পারে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং সাম্প্রতিক চিকিৎসা গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, হার্টের রোগীদের কোন পাশ ফিরে ঘুমানো উচিত সে বিষয়ে নতুন নির্দেশনা এসেছে যা অনেকের জানা ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। এই ব্লগে আমরা জানবো হৃদরোগীদের জন্য সর্বোত্তম ঘুমের পজিশন এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ।
ডান পাশে ঘুমানো— হার্টের রোগীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ডান পাশ ফিরে ঘুমানো হার্টের রোগীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভঙ্গি। ২০১৮ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, ডান দিকে ঘুমালে হৃদযন্ত্র স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে এবং ইসিজি পরীক্ষায় খুব কম পরিবর্তন দেখা যায়।
ডান পাশে ঘুমানোর উপকারিতা:
-
হৃৎস্পন্দনের হার নিয়মিত থাকে
-
ইলেকট্রোকার্ডিয়োগ্রামের রিডিং সঠিক আসে
-
হার্ট ফেইলিওর রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী
-
আইসিডি (ইমপ্ল্যাটেবল কার্ডিওভার্টার ডিফিব্রিলেটর) থাকা রোগীদের জন্য আরামদায়ক
হেলথলাইনের মতে, “হার্ট ফেইলিওরের রোগীদের জন্য ডান পাশে ঘুমানো সবচেয়ে ভালো অপশন। যদিও কেউ কেউ মনে করেন এতে হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহে বাধা হতে পারে, কিন্তু এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই”।
বাম পাশে ঘুমানো— কেন এড়িয়ে চলবেন
একসময় চিকিৎসকরা মনে করতেন বাম দিকে ফিরে ঘুমানো হার্টের জন্য ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা এই ধারণা পরিবর্তন করেছে। ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখা গেছে যে বাম পাশে ঘুমালে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের অবস্থান পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে হার্টের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপে পরিবর্তন আসে।
বাম পাশে ঘুমানোর ঝুঁকি:
-
ইসিজি পরীক্ষার ফলাফলে অস্বাভাবিকতা
-
হৃদযন্ত্রের পেশির সংকোচন-প্রসারণে পরিবর্তন
-
হার্টের ধমনীতে রক্তপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে
-
বিদ্যমান হৃদরোগের জটিলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা
যদিও বাম পাশে ঘুমানো অ্যাসিড রিফ্লাক্স কমাতে সাহায্য করে, কিন্তু হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি বেশি।
চিত হয়ে ঘুমানো— হার্টের রোগীদের জন্য বিপজ্জনক
চিত হয়ে ঘুমানো হৃদরোগীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ভঙ্গি। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, যারা চিত হয়ে ঘুমান তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
চিত হয়ে ঘুমানোর ক্ষতিকর দিক:
-
শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি
-
স্লিপ অ্যাপনিয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি
-
রাতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া
-
হৃদরোগের জটিলতা বৃদ্ধি
২০২৫ সালের একটি গবেষণা দেখিয়েছে যে পজিশনাল অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া মূলত যারা চিৎ হয়ে ঘুমান তাদের হয়, যা হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
উপুড় হয়ে ঘুমানো— হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়, কিন্তু
সুস্থ হৃদযন্ত্রের মানুষদের ক্ষেত্রে উপুড় হয়ে ঘুমানো সরাসরি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে এই ভঙ্গি অন্যান্য সমস্যা তৈরি করতে পারে যা পরোক্ষভাবে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে।
উপুড় হয়ে ঘুমানোর সমস্যা:
-
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অ্যাসিড রিফ্লাক্স বৃদ্ধি
-
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো
-
ঘাড় ও পিঠের ব্যথা
-
মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ
বিশেষজ্ঞদের মতে, “উপুড় হয়ে ঘুমানো প্রত্যক্ষভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি না বাড়ালেও অ্যাসিড রিফ্লাক্স বৃদ্ধি করে যা হার্টের সমস্যার লক্ষণ বাড়াতে পারে”।
বিশেষ ক্ষেত্রে ঘুমের ভঙ্গি
হার্ট ফেইলিওর রোগীদের জন্য:
হার্ট ফেইলিওর রোগীরা প্রায়শই বাম পাশে ঘুমালে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। এ কারণে তারা স্বাভাবিকভাবেই ডান পাশে ঘুমাতে পছন্দ করেন। গবেষণা দেখিয়েছে যে হার্ট বড় হয়ে গেলে এই প্রবণতা আরো বেশি দেখা যায়।
আইসিডি রোগীদের জন্য:
যাদের শরীরে ইমপ্ল্যাটেবল কার্ডিওভার্টার ডিফিব্রিলেটর (আইসিডি) বসানো আছে, তাদের জন্য বিপরীত পাশে ঘুমানো আরামদায়ক। যেহেতু বেশিরভাগ আইসিডি বাম পাশে বসানো হয়, তাই ডান পাশে ঘুমানো বেশি উপকারী।
সঠিক ঘুমের ভঙ্গির জন্য ব্যবহারিক টিপস
ডান পাশে ঘুমানোর জন্য:
-
দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ রাখুন
-
মাথার নিচে উপযুক্ত উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করুন
-
শরীরের সাথে মানানসই গদি নির্বাচন করুন
-
প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও ধীরে ধীরে অভ্যাস করুন
শ্বাসকষ্ট হলে:
কিছু হৃদরোগী শুয়ে থাকতে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। এক্ষেত্রে উপরের অংশ কিছুটা উঁচু করে ঘুমানো উপকারী। ওয়েজ বালিশ বা রিক্লাইনার চেয়ার ব্যবহার করতে পারেন।
হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ঘুমের গুরুত্ব
শুধু ঘুমের ভঙ্গি নয়, পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন ঘুম হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা প্রতিদিন ছয় ঘণ্টার কম ঘুমান তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ২০% বেশি, আর যারা নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমান তাদের ঝুঁকি ৩৪% বেশি।
হার্টের জন্য আদর্শ ঘুম:
-
প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম
-
নিয়মিত ঘুমের সময়সূচী মেনে চলা
-
ঘুমের মান বজায় রাখা
-
ঘুমের ব্যাঘাত এড়ানো
ডাক্তারের পরামর্শ কখন নেবেন
হার্টের রোগীদের কোন পাশ ফিরে ঘুমানো উচিত সে বিষয়ে যদি আপনার সন্দেহ থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। বিশেষ করে যদি:
-
শুয়ে থাকলে শ্বাসকষ্ট হয়
-
রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করেন
-
ঘুমের মধ্যে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয়
-
সকালে ক্লান্তি নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন
চিকিৎসকরা আপনার নির্দিষ্ট অবস্থা অনুযায়ী সবচেয়ে উপকারী ঘুমের ভঙ্গি নির্ধারণ করে দিতে পারবেন।
সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে এটি স্পষ্ট যে হার্টের রোগীদের কোন পাশ ফিরে ঘুমানো উচিত সে বিষয়ে ডান পাশই সবচেয়ে নিরাপদ পছন্দ। বাম পাশে ঘুমানো যদিও অ্যাসিড রিফ্লাক্স কমায়, কিন্তু হৃদরোগীদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চিৎ হয়ে ঘুমানো একেবারেই এড়িয়ে চলুন কারণ এতে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
মনে রাখবেন, সঠিক ঘুমের ভঙ্গি আপনার হৃদযন্ত্রকে অনেক বছর সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে। তাই আজ থেকেই ডান পাশ ফিরে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং একটি সুস্থ হার্টের মালিক হন।