ইউরোপ জুড়ে এক অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে, যার মধ্যে ফ্রান্সে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে যে দেশটির জলবায়ু মন্ত্রী একে “নজিরবিহীন” বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্যারিসসহ ষোলটি বিভাগে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে, যখন আরও ৬৮টি বিভাগ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমলা সতর্কতার অধীনে রয়েছে। এই গ্রীষ্মের প্রথম বড় তাপপ্রবাহ সমগ্র দক্ষিণ ইউরোপকে তীব্র দাবদাহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
তাপমাত্রার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কেবল ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ নেই। স্পেন ও পর্তুগালে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা জুন মাসের জন্য নতুন রেকর্ড। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় গত শনিবার তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে, আর পর্তুগালের মোরায় রবিবার ৪৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।এই অসহনীয় গরমের কারণে উভয় দেশই জুন মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।
ফ্রান্সের আবহাওয়া দপ্তর মেতেও ফ্রান্স জানিয়েছে যে, মঙ্গলবার ও বুধবার দেশটিতে তাপমাত্রার সর্বোচ্চ মাত্রা দেখা যাবে।25 প্যারিস এবং আশেপাশের এলাকায় “অত্যন্ত গুরুতর” পরিস্থিতি বিরাজ করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কিছু এলাকায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে বলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এই তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের শীর্ষ অংশ সোমবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং মঙ্গলবার ও বুধবারও বন্ধ থাকবে।5 এছাড়াও দূষণকারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং গতিসীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ফ্রান্সে প্রায় ২০০টি স্কুল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে এই তাপপ্রবাহের কারণে।1
ইতালিতেও পরিস্থিতি অনুরূপ গুরুতর। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোম, মিলান, ভেরোনা, পেরুজিয়া এবং পালের্মোসহ ১৮টি শহরের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।46 ইতালির বিভিন্ন অঞ্চল তীব্র গরমের সময় বাইরের কাজকর্ম নিষিদ্ধ করার কথা বিবেচনা করছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সরকারের কাছে এই ব্যবস্থা জাতীয়ভাবে প্রয়োগের দাবি জানিয়েছে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, একটি বিশাল “হিট ডোম” ইউরোপের বৃহৎ অংশের উপর স্থির হয়ে আছে, যা জুলাইয়ের প্রথম দিকে পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।3 এই হিট ডোম ২০২৫ সালের গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের চরম আবহাওয়া ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও ঘন ঘন এবং তীব্র হয়ে উঠছে।
দাবানলের ঝুঁকি বৃদ্ধি এই তাপপ্রবাহের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্বিয়ের পর্বতমালায় রবিবার একাধিক দাবানল শুরু হয়েছে, যার ফলে স্থানীয়দের সরিয়ে নিতে হয়েছে এবং একটি মহাসড়ক বন্ধ করতে হয়েছে।1 তুর্কি এবং ইতালিতেও তীব্র গরম ও প্রবল বাতাসের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্রোয়েশিয়ার উপকূলীয় এলাকার সিংহভাগ রেড অ্যালার্টের অধীনে রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন দেশে জরুরি চিকিৎসা সেবা সক্রিয় করা হয়েছে। ফ্রান্সে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর কাছে অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মার্সেইতে বিনামূল্যে সুইমিং পুল খোলা রাখা হয়েছে এবং ভেনিসে বয়স্কদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরে বিনামূল্যে গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই ধরনের তাপপ্রবাহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও তীব্র ও ব্যাপক হয়ে উঠছে।শহুরে এলাকায় “আরবান হিট আইল্যান্ড” প্রভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে, যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ ভবনের মধ্যে তাপমাত্রা আরও বেশি অনুভূত হয়।
গ্রীসেও নতুন করে দাবানলের সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে চরম আবহাওয়ার কারণে। সার্বিয়ার আবহাওয়া সেবা সতর্ক করেছে যে দেশটির বেশিরভাগ অংশে “গুরুতর ও চরম খরা পরিস্থিতি” বিরাজ করছে। এদিকে জার্মানি ও বেনেলাক্স দেশগুলোতেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১২-১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এই তাপপ্রবাহের প্রভাব পরিবেশের উপরও পড়েছে। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ এর উত্তপ্ত পানি ইতিমধ্যে গরম নদীতে ছাড়লে জলজ প্রাণীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।খরা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং দাবানলের ঝুঁকি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই তাপপ্রবাহ আগামী সপ্তাহেও অব্যাহত থাকবে এবং মধ্য ইউরোপে আরও বিস্তৃত হবে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বুধবার সন্ধ্যায় প্যারিসে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গরম আবহাওয়া অব্যাহত থাকবে। এই পরিস্থিতি ইউরোপের জন্য ২০২৫ সালের গ্রীষ্মকালের একটি চ্যালেঞ্জিং শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।