Importance of wearing helmets: মোটরসাইকেল চালকদের জন্য হেলমেট একটি অপরিহার্য সুরক্ষা সরঞ্জাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ হেলমেটের প্রকৃত অর্থ ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। অনেকেই শুধুমাত্র আইনি বাধ্যবাধকতা এড়াতে হেলমেট পরেন, কিন্তু এর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নন।হেলমেট শব্দটির বাংলা অর্থ হল “শিরস্ত্রাণ” বা “মাথার বর্ম”। এটি মূলত মাথা ও মস্তিষ্ককে আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কেবল অর্থ জানলেই চলবে না, এর প্রয়োজনীয়তা ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।
হেলমেটের ইতিহাস ও বিবর্তন
হেলমেটের ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। আদিম মানুষ শিকার ও যুদ্ধের সময় মাথা রক্ষার জন্য নারকেল, আরমাডিলোর খোলস ও কচ্ছপের খোলের মতো প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করত।ধাতব প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ধাতব হেলমেটের আবির্ভাব ঘটে। প্রাচীনতম ধাতব হেলমেট পাওয়া গেছে প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। চীনের আনিয়াং-এর ইয়িন ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত শাং রাজবংশের ব্রোঞ্জ হেলমেটটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধাতব হেলমেট হিসেবে বিবেচিত, যার ইতিহাস ৩,০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো।১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে আগ্নেয়াস্ত্রের আবির্ভাবের পর ব্রোঞ্জ হেলমেটের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি সেনাবাহিনী প্রথম আধুনিক ধরনের হেলমেট তৈরি করে, যা আর্টিলারি শেলের টুকরো প্রতিরোধ করতে সক্ষম ছিল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র M1 ও অন্যান্য ম্যাঙ্গানিজ স্টিলের হেলমেট তৈরি করে, যা আরও উন্নত সুরক্ষা প্রদান করত। ১৯৭০-এর দশকে কেভলার হেলমেটের আবির্ভাব হেলমেট প্রযুক্তিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে।
মোটরসাইকেল সার্ভিসিং: কত দিন পর পর করালে আপনার বাইক থাকবে ফিট?
হেলমেটের প্রকারভেদ
হেলমেটের গঠন অনুসারে এগুলোকে ৬টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
- ফুল ফেস
- মডিউলার
- অফ-রোড
- ডুয়েল স্পোর্ট
- ওপেন ফেস
- হাফ হেলমেট
এর মধ্যে ফুল ফেস হেলমেট সর্বাধিক নিরাপদ, কারণ এটি পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখে। মডিউলার হেলমেট নমনীয়তার জন্য জনপ্রিয়, যেখানে চোয়ালের অংশটি উঠানো-নামানো যায়।
হেলমেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ
একটি উচ্চমানের হেলমেটের কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ রয়েছে:
অংশের নাম | বিবরণ |
---|---|
আউটার শেল | হেলমেটের বাইরের শক্ত আবরণ, যা প্রাথমিক আঘাত শোষণ করে |
ইপিএস লাইনার | আউটার শেল ও কমফোর্ট লাইনারের মধ্যবর্তী অংশ, যা শক শোষণ করে |
কমফোর্ট লাইনার | ব্যবহারকারীর আরাম নিশ্চিত করে |
ভাইজর | চোখ ও মুখমণ্ডল রক্ষা করে |
চিন স্ট্র্যাপ | হেলমেটকে মাথায় সুরক্ষিত রাখে |
হেলমেট ক্রয়ের সময় বিবেচ্য বিষয়সমূহ
হেলমেট ক্রয়ের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে:
- সার্টিফিকেশন: ISI, DOT বা ECE সার্টিফাইড হেলমেট নির্বাচন করুন।
- ফিট: হেলমেট মাথায় আরামদায়ক ও সঠিকভাবে বসা উচিত।
- ভিউ অ্যাঙ্গেল: পর্যাপ্ত দৃষ্টিসীমা নিশ্চিত করুন।
- ভেন্টিলেশন: ভালো বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
- ওজন: হালকা হেলমেট বেশি আরামদায়ক ও ব্যবহারযোগ্য।
- উপাদান: উচ্চমানের প্লাস্টিক, কার্বন ফাইবার বা পলি কার্বনেট নির্বাচন করুন।
- ব্যবহারের মেয়াদ: সাধারণত ২ বছরের বেশি একই হেলমেট ব্যবহার করা উচিত নয়।
হেলমেটের গুরুত্ব ও সুরক্ষা
হেলমেট পরিধান করা শুধুমাত্র আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, এটি জীবন রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে, হেলমেট পরিধান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথার আঘাতজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি ৪২% এবং মারাত্মক আঘাতের ঝুঁকি ৬৯% পর্যন্ত কমাতে পারে।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, নিম্নমানের বা টুপি সদৃশ হেলমেট পরলে দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফ্র্যাকচারসহ বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাই উচ্চমানের, সার্টিফাইড হেলমেট ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে হেলমেট ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবতা হল, অনেকেই এই নিয়ম মেনে চলেন না। অনেকে শুধুমাত্র পুলিশি হয়রানি এড়াতে নিম্নমানের হেলমেট পরেন, যা প্রকৃত সুরক্ষা দিতে পারে না।সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, যার একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এই সংখ্যা কমাতে হেলমেট ব্যবহার বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
লোকসভা নির্বাচনে এক্সিট পোলের ব্যর্থতা: একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা
হেলমেট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উপায়
হেলমেটের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে:
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি: স্কুল-কলেজে নিয়মিত সড়ক নিরাপত্তা ও হেলমেটের গুরুত্ব নিয়ে সেমিনার আয়োজন করা।
- গণমাধ্যমে প্রচারণা: টেলিভিশন, রেডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত হেলমেট ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা।
- সরকারি উদ্যোগ: সরকারি পর্যায়ে হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ও আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
- স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা: চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে হেলমেটের স্বাস্থ্যগত সুবিধা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা।
- কর্মস্থলে সচেতনতা: প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের মধ্যে হেলমেট ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা।
- মোটরসাইকেল ডিলারদের দায়িত্ব: নতুন মোটরসাইকেল ক্রয়ের সময় গ্রাহকদের উচ্চমানের হেলমেট প্রদান ও এর গুরুত্ব বোঝানো।