IRDAI insurance claim rules: জীবনবিমা আমাদের জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, যদি কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় পলিসিধারক এবং তাঁর মনোনীত নমিনি, দুজজনেরই একসাথে মৃত্যু হয়, তাহলে সেই বিমার টাকার দাবিদার কে হবেন? এই প্রশ্নটি জটিল মনে হলেও, ভারতীয় আইন এবং বীমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (IRDAI) এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছে। অনেকেই মনে করেন এমন পরিস্থিতিতে বিমার টাকা হয়তো আর পাওয়া যায় না, কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে, আপনার অনুপস্থিতিতেও আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয় যাতে সঠিক মানুষের হাতে পৌঁছায়, তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব যে, পলিসিধারক এবং নমিনি উভয়েরই মৃত্যু হলে বিমার টাকা কে পাবে এবং এর আইনি প্রক্রিয়াটি ঠিক কেমন।
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ: যখন পলিসিধারক ও নমিনি একসাথে প্রয়াত হন
সাধারণত, পলিসি কেনার সময় একজন নমিনি বা মনোনীত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। পলিসিধারকের মৃত্যুর পর বিমা কোম্পানি সেই নমিনির হাতেই বিমার টাকা তুলে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বা স্ত্রী তাঁর স্বামীকে নমিনি করেন। কিন্তু এমন অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে পুরো পরিবার একসাথে বিপদের সম্মুখীন হয়। যেমন, সম্প্রতি আমেদাবাদে একটি বিমান দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়, যেখানে পলিসিধারক এবং নমিনি দুজনেই ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিমার টাকার কী হবে?
এই জটিল পরিস্থিতিতে IRDAI-এর নিয়ম এবং দেশের উত্তরাধিকার আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল কথা হলো, বিমার টাকা বাজেয়াপ্ত হয় না। টাকাটি পলিসিধারকের এস্টেট বা সম্পত্তির অংশ হয়ে যায় এবং তাঁর আইনি উত্তরাধিকারীরা সেই টাকার দাবি করতে পারেন।
IRDAI-এর নির্দেশিকা এবং আইনি ব্যাখ্যা
যখন পলিসিধারক এবং নমিনি একই ঘটনায় মারা যান, তখন পরিস্থিতি নির্ধারণ করতে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। IRDAI এবং ভারতীয় আইন অনুযায়ী এর দুটি প্রধান দিক রয়েছে।
১. বীমা কোম্পানির অনুমান (Insurer’s Presumption)
বীমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (IRDAI)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, যদি কোনও দুর্ঘটনায় পলিসিধারক এবং নমিনি উভয়েরই মৃত্যু হয়, তাহলে বীমা কোম্পানিগুলো একটি সাধারণ অনুমান অনুসরণ করতে পারে। এই নিয়ম অনুযায়ী, এটা ধরে নেওয়া হয় যে, পলিসিধারকের মৃত্যুর ঠিক পরেই নমিনির মৃত্যু হয়েছে।
এর ফলস্বরূপ, বিমার টাকা প্রথমে নমিনির অধিকারে আসে এবং তাঁর মৃত্যুর পর সেই টাকা নমিনির আইনি উত্তরাধিকারীদের কাছে চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে নমিনি করে একটি পলিসি কেনেন এবং দুজনেই একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে IRDAI-এর এই নিয়ম অনুযায়ী বিমার টাকা তাঁদের সন্তানদের (অর্থাৎ নমিনির আইনি উত্তরাধিকারী) কাছে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি দাবি নিষ্পত্তির সময় জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
২. উত্তরাধিকার আইনের ভূমিকা
যদিও IRDAI-এর নিয়ম দাবি প্রক্রিয়াকে সহজ করে, কিন্তু ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন এক্ষেত্রে চূড়ান্ত কথা বলে। আইন অনুযায়ী, নমিনি কেবল একজন “ট্রাস্টি” বা তত্ত্বাবধায়ক, যিনি পলিসিধারকের মৃত্যুর পর তাঁর আইনি উত্তরাধিকারীদের சார்பে টাকা গ্রহণ করেন। তিনি টাকার চূড়ান্ত মালিক নন।
কর্ণাটক হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায়ে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। আদালত জানিয়েছে যে, বিমা পলিসিতে নমিনেশন থাকা সত্ত্বেও তা দেশের উত্তরাধিকার আইনকে (Succession Law) উপেক্ষা করতে পারে না। অর্থাৎ, যদি পলিসিধারকের আইনি উত্তরাধিকারীরা টাকার দাবি করেন, তাহলে নমিনিকে সেই টাকা তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে। যদি নমিনি এবং পলিসিধারক একসাথেই মারা যান, তাহলে টাকা সরাসরি পলিসিধারকের আইনি উত্তরাধিকারীদের কাছেই যাবে।
নমিনি এবং আইনি উত্তরাধিকারীর মধ্যে পার্থক্য
এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে নমিনি এবং আইনি উত্তরাধিকারীর মধ্যে পার্থক্য জানা প্রয়োজন।
- নমিনি (Nominee): নমিনি হলেন সেই ব্যক্তি যাঁকে পলিসিধারক তাঁর মৃত্যুর পর বিমার টাকা গ্রহণ করার জন্য মনোনীত করেন। নমিনি পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা অন্য যে কেউ হতে পারেন। ২০১৫ সালের বীমা আইন সংশোধনের পর নমিনিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- বেনিফিশিয়াল নমিনি (Beneficial Nominee): পলিসিধারকের নিকটাত্মীয়, যেমন—বাবা-মা, স্বামী/স্ত্রী বা সন্তানরা বেনিফিশিয়াল নমিনি হিসেবে গণ্য হন। এঁরা বিমার টাকার সরাসরি মালিকানা পান।
- কালেক্টর নমিনি (Collector Nominee): ভাই, বোন, বন্ধু বা অন্য কোনও আত্মীয়কে নমিনি করা হলে তাঁরা কালেক্টর নমিনি হিসেবে টাকা গ্রহণ করেন এবং আইনি উত্তরাধিকারীদের কাছে তা পৌঁছে দিতে দায়বদ্ধ থাকেন।
- আইনি উত্তরাধিকারী (Legal Heir): আইনি উত্তরাধিকারী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি দেশের উত্তরাধিকার আইন (যেমন হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬) অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির আইনত মালিক হন। নমিনেশন না থাকলেও বা নমিনি মৃত হলেও আইনি উত্তরাধিকারীরাই সম্পত্তির দাবিদার হন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, উত্তরাধিকারীদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
- প্রথম শ্রেণির উত্তরাধিকারী (Class I Heirs): এঁদের মধ্যে পড়েন মৃত ব্যক্তির মা, স্ত্রী এবং সন্তানরা। যদি কোনও সন্তান আগে মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর ছেলেমেয়েরা এই শ্রেণিতে পড়বেন।
- দ্বিতীয় শ্রেণির উত্তরাধিকারী (Class II Heirs): যদি প্রথম শ্রেণির কোনও উত্তরাধিকারী না থাকেন, তবে মৃত ব্যক্তির বাবা, ভাই, বোন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণির উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হন।
পলিসিধারক এবং নমিনি উভয়েরই মৃত্যু হলে বিমার টাকা কে পাবে?
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, পলিসিধারক এবং নমিনি উভয়েরই মৃত্যু হলে বিমার টাকা কে পাবে, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
- নমিনি যদি পলিসিধারকের আগে মারা যান: যদি নমিনির মৃত্যু পলিসিধারকের আগে হয় এবং পলিসিধারক নতুন কোনও নমিনি যুক্ত না করেই মারা যান, তাহলে বিমার টাকা সরাসরি পলিসিধারকের আইনি উত্তরাধিকারীদের কাছে যাবে।
- পলিসিধারক এবং নমিনি একসাথে মারা গেলে: এই পরিস্থিতিতে, বিমার টাকা পলিসিধারকের আইনি উত্তরাধিকারীরা পাবেন। যদিও IRDAI-এর নিয়ম অনুযায়ী নমিনির উত্তরাধিকারীরা দাবি করতে পারেন, কিন্তু চূড়ান্ত মালিকানা পলিসিধারকের উত্তরাধিকারীদেরই থাকে। যদি কোনও আইনি জটিলতা বা বিতর্ক তৈরি হয়, তবে আদালত উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির উত্তরাধিকারীরা অগ্রাধিকার পান।
দাবি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া (Claim Settlement Process)
যদি পলিসিধারক এবং নমিনি দুজনেই মৃত হন, তাহলে আইনি উত্তরাধিকারীদের বিমার টাকা দাবি করার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
- বীমা কোম্পানিকে জানানো: প্রথম পদক্ষেপ হলো, পলিসিধারক এবং নমিনির মৃত্যুর খবর অবিলম্বে বীমা কোম্পানিকে জানানো।
- নথি জমা দেওয়া: দাবি প্রমাণের জন্য নিম্নলিখিত নথিগুলির প্রয়োজন হয়:
- পলিসিধারক এবং নমিনির ডেথ সার্টিফিকেট (Death Certificate)।
- মূল পলিসির কাগজ (Original Policy Document)।
- দাবিদারের পরিচয়ের প্রমাণপত্র (KYC Documents)।
- উত্তরাধিকার प्रमाणपत्र (Succession Certificate): এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি। যদি কোনও উইল না থাকে বা উত্তরাধিকারী নিয়ে বিতর্ক থাকে, তাহলে আদালত থেকে একটি সাকসেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। এই সার্টিফিকেট প্রমাণ করে যে দাবিদারই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির আইনত উত্তরাধিকারী।
- একাধিক উত্তরাধিকারী থাকলে একটি Indemnity Bond বা ঘোষণাপত্র জমা দিতে হতে পারে।
বীমা কোম্পানি সমস্ত নথি যাচাই করার পর দাবি নিষ্পত্তি করে এবং টাকা আইনি উত্তরাধিকারীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়।
পলিসিধারকদের জন্য কিছু জরুরি পরামর্শ
ভবিষ্যতে এমন জটিলতা এড়াতে প্রত্যেক পলিসিধারকের কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত:
- নমিনির তথ্য আপডেট রাখুন: জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন—বিয়ে, সন্তানের জন্ম বা নমিনির মৃত্যুর পর অবশ্যই পলিসিতে নমিনির তথ্য আপডেট করুন।
- একাধিক নমিনি: সম্ভব হলে আপনার পলিসিতে একাধিক নমিনি যুক্ত করুন।
- উইল তৈরি করুন: একটি সুস্পষ্ট উইল বা ইচ্ছাপত্র তৈরি করে রাখুন, যেখানে আপনার সমস্ত সম্পত্তির পাশাপাশি বিমার টাকা কে পাবেন, তা উল্লেখ থাকবে। এটি আইনি বিতর্ক এড়াতে সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
জীবন অনিশ্চিত, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা আমাদের প্রিয়জনদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারে। পলিসিধারক এবং নমিনি উভয়েরই মৃত্যু হলে বিমার টাকা কে পাবে, এই প্রশ্নের উত্তর এখন আপনার কাছে পরিষ্কার। নমিনেশন একটি জরুরি প্রক্রিয়া হলেও, চূড়ান্ত অধিকার আইনি উত্তরাধিকারীদের হাতেই থাকে। তাই, নিজের পলিসির বিবরণ নিয়মিত পর্যালোচনা করুন এবং আইনি পরামর্শ নিয়ে সমস্ত নথি গুছিয়ে রাখুন, যাতে আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার পরিবার কোনওরকম আর্থিক হয়রানির শিকার না হয়।
